বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি আমাদের “বাংলা রচনা সম্ভার” সিরিজের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” বিভাগের একটি রচনা। রচনা মুখস্থ করার বিষয় নয়। এই নমুনাটি নিয়ে আপনি নিজের মতো চর্চা করুন। তারপর নিজের মতো করে লিখুন।
Table of Contents
বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন
ভূমিকা :
প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা যেমন ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, তেমনি সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতেও পর্যাপ্ত বৃক্ষ থাকা অতীব প্রয়োজন। বৃক্ষহীনতার কারণে পৃথিবীর নতুন নতুন অঞ্চল মরুময় হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানব জীবন বিকল হতে পারে আগামী শতকের মাঝামাঝিতে ।
৩.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার কাঠ ব্যবহার করে প্রতি বছর ৮ হাজার বর্গহেক্টর বনভূমি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের বহু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে বনায়ন বৃক্ষায়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন ।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা :
বৃক্ষ মানব জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বৃক্ষ সমগ্র প্রাণীকুলের খাদ্যের যোগান দেয় এবং সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছায়াদান করে উত্তপ্ত ধরণীকে সুশীতল রাখে। প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ, গৃহনির্মাণ, রেল লাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করতে যে বিপুল পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হয় তা বৃক্ষ থেকে আসে ।
বিভিন্ন শিল্পদ্রব্যের কাঁচামাল যেমন রেয়ন, পেন্সিল, কাগজের মণ্ড, দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স, কর্পূর, রাবার ইত্যাদি বৃক্ষ থেকে আসে। বনভূমি জীবনরক্ষাকারী ভেষজ ওষুধ তৈরির মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করে। বন্যা, খরা ও ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকে । এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে মাটিকে উর্বর রাখে । বৃক্ষ গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া রোধ করে।
বাংলাদেশে বৃক্ষের অবস্থা :
বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি অত্যন্ত কম । তদুপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বনভূমি কর্তনের মাত্রাও ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত। প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৯৪৭ সালে দেশের আয়তনের ২৪ ভাগ বনভূমি ছিল। ১৯৮০-৮১ সালে তা কমে হয় ১৭.২২ ভাগ এবং বর্তমানে মাত্র ১৭.৫ ভাগ বনভূমি রয়েছে। এ আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবিধ প্রয়োজন মেটানো।
এর মধ্যে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্রের ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার, নগরায়ন ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে জ্বালানি হিসেবে বনসম্পদের ব্যবহার ৯৫ শতাংশ দায় ভাগ বহন করে। এ ছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বৃক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে। অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রয়োজনে বৃক্ষ সংকট এক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্বের বৃক্ষের অবস্থা :
বৃক্ষ সভ্যতার সহায়ক। কিন্তু জাতিসংঘের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের সুসভ্য ও উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ অপেক্ষা অধিকহারে বৃক্ষ কর্তন করছে। এর নানা অশুভ প্রতিক্রিয়া সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করছে। ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, দুই মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাত কমে গেছে এবং সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের উপকূলবর্তী ভূ-ভাগ সাগরতলে ডুবে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ওজন স্তরে ফাটল ধরছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে গ্রীন হাউস ইফেক্টের মতো মারাত্মক সমস্যা। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ অবস্থার প্রতিকার না হলে ২০৫০ সালের দিকে সারা বিশ্বে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে এবং জীবনযাত্রা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত বনাঞ্চল এবং বৃক্ষরোপণ :
বনভূমি দ্রুত ফুরিয়ে আসায় সারা বিশ্বের জনগণের সচেতনতার সাথে সাথে বাংলাদেশের সরকার ও সচেতন জনগণ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের বৃক্ষহীনতায় নিচের দূষণগুলো ঘটছে :
ক. বায়ুদূষণ :
বৃক্ষ পরিবেশ থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। ধোঁয়া ও বালি, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, ধাতব কণা, আয়নাইজিং বিকিরণ, আগাছানাশক, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক, কার্বন ডাই-অক্সাইড, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি হলো বায়ুদূষণের উৎস।
ঢাকা শহরে সিসা, কার্বনমনোক্সাইড, হাইড্রোকার্বন প্রভৃতি উপাদান বাতাসে বিষাক্ততা ছড়িয়ে দিয়েছে। এ কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস শরীরে ঢুকে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। হাইড্রোকার্বন যকৃতের ক্যান্সার ঘটায়। বাতাসে বিদ্যমান বিভিন্ন ধূলিকণা শ্বাসকষ্ট ও এলার্জির কারণ। সালফার ডাই-অক্সাইড বিভিন্ন ধরনের শস্যের ক্ষতি করে। এসিড বৃষ্টির ফলে মাটিতে পানির [হ্রাস পায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। এ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পর্যাপ্ত সংখ্যক সবুজ উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে ।
খ. গ্রিন হাউস ইফেক্ট :
গ্রিন হাউস অর্থ হলো সবুজ ঘর। মূলত এটা একটা কাচের ঘর যার মধ্যে তাপ সংরক্ষণ করে সবুজ গাছপালা জন্মানো হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাপ অপরিবাহী গ্যাসের আবষ্টেনীর জন্য সূর্য থেকে প্রাপ্ত তাপ ধরে রাখার মতো গ্যাসীয় আবরণ সৃষ্টি হয়েছে । এ গ্যাসীয় আবরণ গ্রিন হাউসের কাচের মতো কাজ করে। এ তাপ ধারণ অবস্থা যখন নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা জীবকুলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। কাচের দেয়াল ও ছাদবিশিষ্ট গ্রিন হাউসের ভেতরের উত্তাপ কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে যেতে পারে না।
গ্রিন হাউসের কাচ যেমন প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, তেমনি কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি গ্যাসে তাপ বিকিরণে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৮০ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে, আর্কটিক মহাদেশের বিশাল বরফস্তর ক্ষয়ে যাবে যার ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে । সমুদ্রে পানির উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মালদ্বীপ, বাংলাদেশসহ বহু দেশ ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। গ্রিন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে বৃক্ষ কাটা রোধ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। নতুবা এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
গ. ভূমিক্ষয় :
বৃক্ষহীনতার কারণে অনবরত ভূমিক্ষয় বাড়ছে, নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে এবং খরা ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। ড. তারক মোহন দাসের মতে, একটা গাছ তার পঞ্চাশ বছর জীবনকালে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের মাটির ক্ষয় রোধ ও উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই ভূমিক্ষয় রোধে বৃক্ষরোপণ আশু প্রয়োজন ।
ঘ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ :
বাংলাদেশে উপকূলীয় দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীহীনতার কারণে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও বান্দরবান দুর্যোগের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্ভিদ :
পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে উদ্ভিদ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রাণীজগৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ও দহনকার্যের ফলে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়মণ্ডলে যোগ করছে এবং সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করছে। প্রাণীজগৎ যেমন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে, অন্যদিকে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করছে। সবুজ উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের এ ভয়াবহতা দূর করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। সবুজ উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে।
উদ্ভিদ মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে মাটির ক্ষয়রোধ করে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলে পাশ্চাত্যের বড় বড় শহরগুলো হয়ে উঠেছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত। অপরদিকে প্রাচ্যের দেশগুলো দিনের পর দিন বৃক্ষ হত্যা করে চলছে। তাই প্রাচ্যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছে পরিবেশ সচেতন মানুষের পরিবেশবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার ।
বৃক্ষরোপণ অভিযান :
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা যেমন স্নান করি, সূচিবস্ত্র পরি, তেমনি বাড়ির চারদিকে যত্নপূর্বক একটি বাগান করে রাখা ভদ্রপ্রথার অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত। সরকার বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব সবাইকে অনুধাবন করাতে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে তৎপর হয়েছেন । সরকারপ্রধান বৃক্ষরোপণের তাৎপর্য তুলে ধরে একটি শ্লোগান নির্দিষ্ট করেছেন, ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। বলা হচ্ছে একটি গাছ কাটলে তার বদলে তিনটি গাছ লাগাতে হবে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশ বাঁচাতে সরকার জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহকে বেছে নিয়েছে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ হিসেবে । এ সময়ে মৌসুমী বৃষ্টিপাত হওয়ায় বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার নিজ উদ্যেগে বিভিন্ন নার্সারি থেকে লাখ লাখ বৃক্ষচারা জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে নতুবা নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করছে । সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও এবং সংস্থা বৃক্ষরোপণে এগিয়ে এসেছে। সরকার শুধু বৃক্ষরোপণ নয়, বৃক্ষকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত দায়িত্ব নিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে উপকূলবাসীকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে।
বনজসম্পদ উন্নয়ন :
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি খুবই কম। নির্বিচারে বৃক্ষকর্তনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে বর্তমানে মোট স্থলভাগের শতকরা ৯.৩ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ দরকার । নিম্নবর্ণিত উপায়ে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন করা যেতে পারে :
নতুন বনভূমি সৃষ্টি :
বাংলাদেশের নদীতীর, উপত্যকা, পাহাড়ি উচ্চ অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলে বনভূমি গড়ে তুললে বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাবে।
নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন রোধ :
আমাদের বনজসম্পদের ওপর মানুষের বেপরোয়া হামলা চলছে। নির্বিচারে বৃদ্ধকর্তন রোধ করে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া বনকে পুনরায় সজীব করে তোলার সার্বিক ব্যবস্থ গ্রহণ করতে হবে ।
আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি রোধ :
মানুষ আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি করতে নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন করে চলছে, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি রোধ করতে হবে। মূল্যবান বৃক্ষ বিনা অনুমতিতে কর্তন নিষিদ্ধকরণ : মূল্যবান বৃক্ষসমূহ সরকারি অনুমতি ছাড়া কর্তন নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারি তত্ত্বাবধান : দেশের সকল বনাঞ্চল সরকারি তত্ত্বাবধানে এনে বনাঞ্চলের সংরক্ষণ ও নতুন বৃক্ষের চারা রোপণের সক্রিয় ব্যবস্থা করলে বনজ সম্পদের উন্নয়ন বহুলাংশে সম্ভব ।
প্রশিক্ষণ ও গবেষণা : বনজসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য বনবিভাগের কর্মকর্তাদের পর্যান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে গবেষণারও সুযোগ থাকতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ : বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ এবং অভয়ারণ্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গৃহীত হলে বনজসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।
জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি :
বনাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেনতা বৃদ্ধি করে বিনামূল্যে বিভিন্ন জাতের চারাগাছ সরবরাহ করতে পারলে বনায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হবে।
বনবিভাগীয় কর্মচারীদের দুর্নীতি দমন :
বিভিন্ন প্রকার কাঠের চোরাকারবারী এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের সাথে বনবিভাগীয় বহু কর্মচারী জড়িত রয়েছে। বনজসম্পদের উন্নয়নের জন্য তাদের দুর্নীতি দমন করা প্রয়োজন।
বনজসম্পদ উন্নয়নে সরকারি ব্যবস্থা :
বাংলাদেশ সরকার দেশের বনজসম্পদের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বনজসম্পদের উন্নয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে এবং বনবিষয়ক শিক্ষা প্রদানের জন্য সিলেটে একটি বন মহাবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বনজসম্পদের ওপর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বেসরকারিভাবে কাঠ ও অন্যান্য দ্রব্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বন এলাকা সম্প্রসারণের জন্য বনের আশপাশের জমি সরকারি দখলে আনা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ রোপণ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে প্রায় ৫২,০০০ একা জমিতে নতুন বন সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায় ৪০,০০০ একর জমিতেও নতুন বন সৃষ্টি করা হয়েছে । দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে ১৩,০০০ একর নতুন জমিতে রাবার গাছ লাগানো হয়েছে । সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১৫,০০০ একর জমিতে সেগুন ও মেহগনি গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোতেও বৃক্ষরোপণের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বৃক্ষসম্পদ উন্নয়নে করণীয় :
বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে :
১. সামাজিক বনায়নের জন্য নতুন এলাকা বেছে নিতে হবে। যেমন নদীর ধার, পাহাড়ের ঢাল, উপকূল, রেল বা সড়কের পাশে অধিক হারে গাছ লাগাতে হবে।
২. বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য আর কোনো গাছ যেন না কাটা হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ কাটা হলে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করে শূন্যতা পূরণ করতে হবে।
৩. বনভূমির নতুন নতুন এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশে নতুন নতুন বন সৃষ্টি করে তা অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাণীদের রক্ষায় যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আমাদের দেশেও সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. জ্বালানি হিসেবে কাঠের বিকল্প খুঁজতে হবে এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে গ্যাস বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই সেখানে সৌরশক্তিকে কাঠের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. বৃক্ষরোপণকে শুধু সপ্তাহে সীমাবদ্ধ না রেখে বছরের সব সময়ই তা চালিয়ে যেতে হবে। বর্ষাকালের পুরো সময়ই এ কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।
৬. সরকারিভাবে বনায়নের যে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে তা দূর করতে হবে। বনভূমি সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
৭. চোরাই পথে বৃক্ষ ও প্রাণী নিধন দূর করতে হবে। সবাই সচেতন হলে সরকারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি সার্থক হবে।
উপসংহার :
বৃক্ষরোপণ বা বৃক্ষসম্পদের উন্নয়ন আমাদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কাজেই কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। আমাদেরকে আন্তরিকভাবেই বনজসম্পদের উন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কেবল সরকারি বা এনজিও পর্যায়ে নয়, এ ব্যাপারে আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগী হতে হবে।
আরও দেখুন: