বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য – আজ আমাদের প্রবন্ধ রচনায় বিষয়। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি। আপনারা চর্চা করে নিজের মতো করে লিখুন।
বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য
ভূমিকা :
আমরা বর্তমানে একবিংশ শতকের অধিবাসী। সবেমাত্র নতুন শতাব্দী এসেছে। বাংলা সাহিত্যের শুরু হয়েছিলো আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। শুরুর দিকে ছিলেন কাহ্নপা, লুইপারা, আমরা আছি এ প্রান্তে। তবে শেষ প্রান্তে নয়। আরো অনেক শতক টিকে থাকবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। রূপ নেবে নতুন নতুন। হয়তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নতুনরূপে অপূর্ব শোভাময় হয়ে আবির্ভূত হবে।
গত এক হাজার বছর ধরে বাংলা সাহিত্যাকাশে নতুন নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়েছে আর বাংলা সাহিত্যকে করেছে আলোকিত। উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিল এক ধরনের আধুনিক। বিশ শতকে বাংলা সাহিত্য হয়ে ওঠে নতুন ধরনের আলোয় উজ্জ্বল। আধুনিকতা বলতে এখন আমরা বিশ শতকের আধুনিকতাকেই বুঝে থাকি। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক সব ক্ষেত্রেই দেখা দেয় নতুন চেতনা, নতুন সৌন্দর্য। বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছুরিত হয় দুরূহ জটিল অভিনব আলো।
বিশ শতকের প্রথমভাগে বাংলা সাহিত্য :
একটি শতক কেটে গিয়ে যখন আরেকটি শতক আসে, তখন নববর্ষের মতো রাতারাতি নতুন চেতনার উন্মেষ বিকাশ ঘটে না। নতুন শতকের এক বা দু দশক ধরে জীবনে ও সাহিত্যে রাজত্ব করতে থাকে পুরনো শতকেরই চেতনা। তারপর এক সময় প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তার বিরুদ্ধে। তখন সাহিত্য ও শিল্পকলায় নতুন চেতনা অভিনব রূপ ধরে দেখা দেয়। আমরা পুরাতন চেতনাকে বেশিদিন ধরে রাখতে ভালোবাসি। তাই বিশ শতক আসার পরও দু দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের চেতনাই প্রকাশ পেতে থাকে। কারণ এ সময় রবীন্দ্রনাথ লিখে চলছিলেন তার অসামান্য দীপ্তিময় কাব্যসাহিত্য। তখনো তার কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সময় আসেনি।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঘটে মানুষের ইতিহাসের প্রথম সবচেয়ে বড় সংকট–প্রথম মহাযুদ্ধ। ইউরোপীয় সাহিত্যের মতো অবিশ্বাস, ক্লান্তি, অমানবিকতা, নৈরাশ্য প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে নানাভাবে প্রকাশ পেয়ে সৃষ্টি করে নতুন আধুনিক সাহিত্য। এ আধুনিকতা প্রথমে এসেছিলো কবিতায় যাকে বলে ‘আধুনিক কবিতা’। ওই আধুনিক কবিতাই বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, উজ্জ্বলতম আলোকমালা।
এ সময় রবীন্দ্রনাথ তার চল্লিশোত্তর বয়সের আশ্চর্য কবিতার রোমান্টিক বন্যায় প্লাবিত করেন পাঠকের চিত্ত। তার নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, গীতাঞ্জলী, বলাকা অমর সৃষ্টি। জীবনের প্রথমার্ধে যেসব বোধ, বিশ্বাস, আবেগ অঙ্কুরিত হয়েছিলো তার মনোলোকে, এ সময়ে তাই পুষ্পিত হয়েছিল তার কবিতায়। তবে এ কথা সত্য ওই সব পুষ্পের মূল ছিলো উনিশ শতকে।
এ সময়ই কিছু তরুণ কবি রবীন্দ্রপ্রভাবে প্রভাবিত হয়ে চমৎকার কাব্যসাহিত্য রচনা করেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি হালকা ছন্দের যাদু সৃষ্টি করে প্রচুর কবিতা লিখেছিলেন এবং ছন্দের যাদুকর উপাধি পেয়েছিলেন। তার কয়েকটি কাব্য ‘বেণু ও বীনা’, ‘কুহু ও কেকা’, ‘অভ্র-আবীর’। এ সময়ে যতীন্দ্র মোহন বাগচী গুটিকয়েক মনোরম কবিতা লিখেন। তার ‘কাজলা দিদি’ একটি বেদনাকাতর অমর কবিতা। ‘রেখা’, ‘অপরাজিতা’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্য। এ সময় কুমুদরঞ্জন মল্লিক লিখেছিলেন পল্লীপ্রেমের কবিতা। তার কাব্য–উজানী, বনমল্লিকা, রজনীগন্ধা উল্লেখযোগ্য। এরা সবাই ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাবিত। রবীন্দ্র বাসর থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুতরাং বিশ শতকের চেতনা তাদের কবিতায় নেই।
রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে যারা নতুন আধুনিক কাব্যধারার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তারা হলেন মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও কাজী নজরুল ইসলাম। মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘স্বপন-পসারী’। যতীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রস্থ হচ্ছে ‘মরীচিকা’, ‘মরুশিখা’, ‘মরুমায়া’।
কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত বিখ্যাত। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি শুধুই বিদ্রোহী ছিলেন না। বিদ্রোহের বিপরীত আবেগও রয়েছে তার কবিতায় ও গানে। তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে তারুণ্যের আবেগ আর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বিরহ কাতরতা। তার খ্যাতির মূলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে প্রবলভাবে। তার কাব্য হচ্ছে ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ভাঙ্গার গান’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ছায়ানট’।
কবি জসীমউদ্দীন ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। তিনি পল্লীর জীবন ও কিংবদন্তি অবলম্বন করে। কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘পল্লীকবি’ নামে। অবশ্য তার মধ্যে কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রভাব ছিলো। তার কাব্য—রাখালী, নকশী কাঁথার মাঠ, বালুচর, সোজন বাদিয়ার ঘাট উল্লেখযোগ্য। তার রচিত ‘কবর’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমর বিয়োগাত্মক কবিতা।
আধুনিকতার জন্ম :
বিশ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা দেয় আধুনিক কবিতা। এ কবিতার মধ্য দিয়েই বিশ শতকে প্রবেশ করে বাংলা আধুনিক সাহিত্যের দ্বারপ্রান্তে। রবীন্দ্রনাথের পর আধুনিক কবিতাই প্রকৃত অভিনব আধুনিকতার জন্ম নেয়। এর চেয়ে অধিক মূল্যবান আর কিছু সৃষ্টি হয়নি বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে। এ কবিতায় বদলে যায় বাঙালির চেতনা। দেখা দেয় নতুন জটিল বিস্ময়কর শোভা। আবেগের পরিবর্তে তারা মননশীলতার স্থান দেন। নতুন কবিতা সৃষ্টির জন্য তারা বিদেশী কবিতার আশ্রয় নেন।
ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান কবিতা থেকে তারা সংগ্রহ করেন প্রেরণা। স্বাভাবিক প্রতিভা ও অধীত জ্ঞানের মিলনে সৃষ্টি করেন অভিনব কবিতা। বাংলা ভাষায় যারা আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের মধ্যে পাঁচজন প্রধান। তারা হলেন : ১. বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮– ১৯৭৪), ২. জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯–১৯৫৪), ৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১–১৯৬০), ৪. বিষ্ণু দে (১৯০৯–১৯৮২) ও ৫. অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১–১৯৮৬)।
এছাড়া প্রেমেন্দ্র মিত্রও আধুনিক কবিতার বিকাশে সাহায্য করেছিলেন। এসব কবি ছাড়াও আধুনিক কবিতার উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা। এর মধ্যে ‘কল্লোল’ ও ‘কালি কলম’ বের হতো কলকাতা থেকে এবং ‘প্রগতি’ বের হতো ঢাকা থেকে।
দুঃখ আমাদের মুখরা ননদিনী, মৃত্যু আমাদের পূজ্য ব্রাহ্মণ,
তবু তো কিছু ভালো মেনেছি সংসারে, জেনেছি দেবতারা বন্ধু—
যেহেতু ফলে ওঠে সোনালী ধান আর সোনার সন্তান মায়ের কোলে,
এবং অগ্নি ও জলের মিতালিতে অমৃত স্বাদ পায় অন্ন।
আধুনিকদের মধ্যে এখন জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতাকে বলেছিলেন—চিত্ররূপময়। করুণ, বিষণ্ন, স্বপ্নময়, আর আশ্চর্য শোভাময় তার কবিতা। ক্লান্তি, বিষাদ, হতাশা প্রভৃতি তার কবিতায় সোনার টুকরোর মতো সুন্দর হয়ে আছে। বাংলার অতীত ও বর্তমান প্রাকৃতিক শোভা তার কবিতায়ই অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছে। আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ উপমা রচনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, রূপসী বাংলা। তিনি চমৎকার উপন্যাসও লিখেছেন। তার উপন্যাসের নাম ‘মাল্যবান’। তার রূপভারাতুর একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি
চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে।
পাড়া-গাঁর পায় আজ লেগে আছে রূপশালি—ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ।
আধুনিক কবিদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন শ্রেষ্ঠ কবি। আবেগ ও মননশীলতার এক অপূর্ব মিশ্রণ তার কবিতা। তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন প্রচুর অপ্রচলিত শব্দ। তাই তার কবিতা দুরূহ বলে মনে হয়। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো— ‘তন্বী’, ‘অর্কেস্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তরফাল্গুনী’। তার একটি আবেগস্পন্দিত কবিতার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ :
একদা এমনই বাদল শেষের রাতে
মনে হয় যেন শত জনমের আগে
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিলো হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া—অনুরাগে।
বিষ্ণু দে আধুনিকদের মধ্যে বেশি কবিতা লিখেন। আধুনিকদের মধ্যে তারই একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন ছিলো, তা হচ্ছে সাম্যবাদ। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’, ‘চোরাবালি’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
আধুনিক কবিতার সূচনার পর নতুন নতুন আধুনিকেরা বাংলা কাব্যসাহিত্যকে করে তোলেন গভীর, ব্যাপক ও বিচিত্র। প্রথম আধুনিকদের পর যার নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন সমর সেন। এ সময়েই এক অসাধারণ কবি প্রতিভা দেখা দেয়। তিনি হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষায় মার্কসীয় ধারার শ্রেষ্ঠ কবি সুকান্ত। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যসাহিত্য—’ছাড়পত্র’, ‘পূর্বাভাস’, ‘ঘুম নেই’।
বিশ শতকের কথাসাহিত্য :
এ শতকের কথাসাহিত্য, গল্প, ছোটগল্প, উপন্যাস যে নতুন হবে এবং বিশ শতকের বাস্তব ও স্বপ্নকে প্রকাশ করবে এটাই স্বাভাবিক। এ শতকের গল্পকার ও ঔপন্যাসিকরা তাদের গল্প ও উপন্যাসে নতুন নতুন প্রশ্ন তুলেছেন, জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন নতুন চোখে। তাদের রচনায় ধরা পড়েছে বিচিত্র কামনা-বাসনা এবং অনেক নিষিদ্ধ কথা প্রকাশ পেয়েছে অবলীলায় বাংলা উপন্যাসে ছজন শ্রেষ্ঠ পুরুষের মধ্যে রয়েছেন শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারা ছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার।
তারা সবাই মিলে বিশ শতকের কথাসাহিত্যকে জীবনের মতো ব্যাপক করে। তুলেছেন। এরা হলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বনফুল, সতীনাথ ভাদুড়ী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। আমাদের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার এবং শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকও। তার সাহিত্য প্রতিভার কোনো তুলনা নেই। তার তুলনা তিনি নিজেই।
রবীন্দ্রনাথের পর সাড়া জাগিয়ে আবির্ভূত হন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন। তিনি রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার লেখায় রক্ষণশীলতা বিচলিত হয়ে উঠেছিল। তার উপন্যাসে নিষিদ্ধ কামনার জয় হয়েছে।
বিশ শতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পথের পাচালী তাকে অমরত্ব দান করেছে। মানুষ ও নিসর্গ তার উপন্যাসে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হয়ে আছে। বাংলা ভাষার অতি প্রশংসিত ঔপন্যাসিকদের একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মনের গোপন কামনা-বাসনা থেকে শ্রেণীসংগ্রাম রূপ পেয়েছে তার উপন্যাসে। বিশ শতকের অসাধারণ ফসল ছোটগল্প। এর স্রষ্টা হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তার ছোটগল্পে জীবন ও
শিল্পের বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটিয়েছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন অসাধারণ গল্প। এসব গল্প বিশ শতকের সাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
বিশ শতকের গদ্যসাহিত্য :
বিশ শতকের অতুলনীয় গদ্যশিল্পী হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরী। তারা অমর হয়ে আছেন তাদের অনন্য গদ্যশিল্পের জন্য। অবনীন্দ্রনাথ আধুনিককালের একজন প্রধান চিত্রকর। আর প্রমথ চৌধুরী বিখ্যাত হয়ে আছেন চলিত রীতির প্রধান প্রবক্তা হিসেবে। তিনি চলিত ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিসেবে ব্যবহারের আন্দোলন শুরু করেন এবং সফল হন। শুধু চলিত রীতির প্রবক্তা হিসেবেই নয়, অনন্য গদ্যরীতির জন্যও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন; কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তার অমূল্য অবদান তার প্রবন্ধাবলী। ‘চার ইয়ারী কথা’ তার গল্পগ্রন্থ ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ নামে দুই খণ্ডে সংগৃহীত হয়েছে তার প্রবন্ধ। অন্যান্য তার গদ্য।
বিশ শতকের নাট্যসাহিত্য:
নাটকে বাংলা সাহিত্য বেশ গরিব। উনিশ শতকের দ্বিতীয় অংশে বেশ কয়েকজন বড় নাট্যকার দেখা দিয়েছিলেন। বিশ শতকে তেমন কোনো প্রসিদ্ধ নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটেনি। নাটক রচিত হয় মঞ্চস্থ হবার জন্য। মঞ্চ সফল হতে পারা নাটকের একটি বড় গুণ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের মঞ্চ সফল অধিকাংশ নাটক সাহিত্যের দৃষ্টিকোণে উৎকৃষ্ট নয়। বিশ শতকে নাটকের ক্ষেত্রে বড় কোন প্রতিভা চোখে পড়ে না। বিশ শতকের রবীন্দ্রনাথই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তার নাটক জীবনচিত্রণ নয়—ভাবচিত্রণ, তবুও সাহিত্যদৃষ্টিতে তার নাটক অসামান্য, উৎকৃষ্ট। এর বেশ পরে বুদ্ধদেব বসু কিছু উন্নত সাহিত্যিক নাটক রচনা করেছেন। এর পরে তেমন বড় নাট্যকার আসেনি।
বিশ শতকের সময়কার উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, ওয়ালীউল্লাহ, সিকান্দার জাফর। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নাট্যকার আবদুল্লাহ মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘ওরা কদম আলী’, শামসুল হকের আওয়াজ পাওয়া যায়’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়াও আল-মনসুর, মামুনুর রশিদ, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আতিকুল চৌধুরী, সেলিম আল-দীন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক প্রমুখ নাট্যকার উল্লেখযোগ্য। তারা বর্তমান যুগোপযোগী রচনা করছেন। তাদের নাটক বিশ শতকের সাহিত্যের দৈন্যদশা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্য বিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে পরিপূর্ণতা লাভ যথেষ্ট। ঢাকার বাইরে বহু গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে সেখানে নিয়মিত নাট্যচর্চা হচ্ছে। এছাড়াও নাট্যচর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলা একাডেমী নাটকের প্রকাশনায় এগিয়ে আসছে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতাও করছে।
বিশ শতকের শেষার্ধে এবং আরো আস্তে আস্তে যাচ্ছে। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় বর্তমান সময়ের সাহিত্যপ্রেমিকরা কাব্যসাহিত্যের প্রতি ক্রমশ বিমুখ হয়ে পড়ছেন। আজকালকার সমাজ সভ্যতা বাস্তববাদী পড়েছে। তুলনায় বাস্তববাদী কবির সংখ্যা কম। বিশ শতকের কতিপয় উল্লেখযোগ্য কবি তাদের কবিতায় বাংলা সাহিত্যকে যথেষ্ট মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে কাব্যসাহিত্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিক সাথে চেতনাবোধ ও বাস্তব রূপায়নে কবিরা সৃষ্টিমুখর হয়ে উঠেছেন। অদূর ভবিষ্যতে বাংলা কাব্যসাহিত্য ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠবে। একুশ বাংলা কাব্যসাহিত্য নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে স্নাত, নির্মল ও সুষমাময় করে তুলবে।
উপসংহার :
বিশ শতক কেটে গেছে। এ শতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি সময়ে যে আধুনিক সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল এ শতকের কেননা এ সময়ে অনুকূল পরিবেশ। তাই তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এমন সাহিত্য। আগামী একুশ শতকে দেখা দেবে নতুন চেতনা। বিশ শতকের চেতনাকে করে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হবে। তা হয়তো বহুবর্ণের দীপাবলী হয়ে দেখা দেবে একুশ শতকের প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে। চিরকাল জ্বলবে বাংলা সাহিত্যের লাল-নীল দীপাবলী।
অনুরুপ প্রবন্ধ:
- সাহিত্যে আধুনিকতা
- বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা
আরও পড়ুন: