বিশ্ব শিশু দিবস রচনা

বিশ্ব শিশু দিবস রচনা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি আমাদের “বাংলা রচনা সম্ভার” সিরিজের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” বিভাগের একটি রচনা। রচনা মুখস্থ করার বিষয় নয়। এই নমুনাটি নিয়ে আপনি নিজের মতো চর্চা করুন। তারপর নিজের মতো করে লিখুন।

বিশ্ব শিশু দিবস রচনা

বিশ্ব শিশু দিবস রচনা

ভূমিকা :

বিশ্ব শিশু দিবসের অঙ্গীকার শিশুর জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়া। এ অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়। বর্তমানে এ দিবস পালন করা হয় জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ’ পালনের অঙ্গীকার নিয়ে।

 

বিশ্ব শিশু দিবস :

জাতিসংঘ ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো— শিশু- কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথনির্দেশ না দিতে হবে।

বিশ্ব শিশু দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

শিশু দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় ও বেদনাদায়ক স্মৃতি এ দিবসটির জন্য দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে শত শত ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু মারা যায়। অনেক বড় শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হাজার হাজার শিশু অসহায় ও পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে। পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয় অনেকে। জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল (UNICEF) এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ দিন সামগ্রিক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের সমস্যাবলী বিশ্ব ফোরাম তুলে ধরে এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

 

শিশু দিবসের তাৎপর্য :

বিশ্ব শিশু দিবসের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। তাই জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সারা বিশ্বে অক্টোবর মাসে প্রথম সোমবার পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ-সাধন এবং তাদের নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে তাদের মৌলিক অধিকার আদায় করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখনো ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ সম্পর্কে সচেতন নয়।

এর জন্যে এ দিবসটির কর্মসূচি এমনভাবে করতে হবে যেন জনগণ এর তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। কেবলমাত্র কাগজে-কলমে শিশুদের অধিকারের কথা লিখে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাস্তবে এর রূপ দিতে হবে। এর জন্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবার। তৃতীয় বিশ্বের সন্তানদের দিকে তাকালে একটা বিষয়ই ধড়া পড়ে বিশ্ব শিশু দিবস, শিশু সনদ ইত্যাদি যেন আমাদের সন্তানদের জন্যই করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ কতটুকু তা ভাববার বিষয়।

 

শিশু অধিকার সনদ :

বর্তমানে বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয় জাতিসংঘ ঘোষিত ‘শিশু অধিকার সনদ” পালনের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। জাতিসংঘে ১৯৫৯ সালে প্রথম ‘শিশু অধিকার সনদ’ নামে প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৭৯ সালে ‘বিশেষ শিশু বছর’ পালিত হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানগণ শিশুর অধিকার নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে ৫৪টি ধারা সংবলিত শিশু অধিকার সনদ’ প্রণয়ন করেন। এ সনদ ‘শিশু অধিকার সনদ-৯০’ নামে পরিচিত।

 

শিশু অধিকার সনদের মূল কথা :

জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের মূল কথা হচ্ছে : শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য চাই নিরাপদ পরিবেশ, চাই তার সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা, তার চাই খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, চাই পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সেবা, চাই উপযুক্ত শিক্ষা। এক কথায় শিশুকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাই অভাবমুক্ত ও অনুকূল জীবন-পরিবেশ।

 

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ :

আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। একটি নাবজাত শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার হলো তা একদিন ফুলে ফলে প্রস্ফুটিত হবে। বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল করবে। Wordsworth-এর ভাষায়— ‘Child is the father of a nation’ বস্তুত শিশুর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কারণ, শিশুই একদিন বড় হয়ে দেশ ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা হবে দেশের আদর্শ নাগরিক। এজন্য চাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন, বিকাশ সাধনের সুষ্ঠু পরিবেশ। শিশুদেরকে আদর, সোহাগ, যত্ন ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষা।

উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষ রূপে বড় হয়ে উঠতে পারে। শিশুর মন ফুলের মতো পবিত্র, সরল। সে সে পরিবেশে থাকে সে তার পারিপার্শ্বিক আচার-আচরণ অনুকরণ করে এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একটি নির্মল ফুলের মতো পবিত্র শিশু খারাপ পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে, কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ, অসৎসঙ্গ ও বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়ে অমানুষ, বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্রের হতে পারে। সম্ভাবনাময় আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে।

পক্ষান্তরে সুশিক্ষা, সুরুচি, শিক্ষিত বিবেকবান অভিভাবক একটি শিশুর অন্তর সুপ্ত ভবিষ্যতের পিতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। এর ফলে জাতি পেতে পারে একজন আদর্শ চরিত্রবান নাগরিক, যার দ্বারা দেশ ও সমাজ সঠিক পথে চালিত হতে পারে। আর উন্নত চরিত্র, মহান মানুষের সমবায়েই একটি মহৎ জাতি গড়ে ওঠে। যেহেতু শিশুর মধ্যে জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বীজ লুকায়িত থাকে, তাই শিশুর সফর প্রতিপালন, সুশিক্ষা ও চরিত্র গঠনে প্রত্যেক অভিভাবককে দায়িত্ব নিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন ।

বিশ্ব শিশু দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য :

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগই শিশু। এটা পরম সত্য যে, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তারাই একদিন সুনাগরিক হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তারা অবহেলিত থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুখ থুবড়ে পড়বে। এহেন ভয়াবহ অবস্থার কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশই শিশু সমাজকে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে— কী করে এদেরকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, কিভাবে এদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সুন্দর মানব-সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়তে হবে। কারণ, শিশুর প্রতি অযত্ন অবহেলা কোনো বিবেকবান মানুষেরই কাম্য নয়।

 

বিশ্বে শিশুদের অবস্থান :

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকারগুলো সবদেশেই স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতিদানকারী বহু দেশে এ অধিকারগুলো নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বের একটি  অংশের শিশুরা যেসব অধিকার ভোগ করছে অপর অংশের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত থাকছে। সেসব অধিকার ভোগের কোনো সুযোগই তাদের নেই। তারা পাচ্ছে না ক্ষুধায় অম্ল, পরনের কাপড়, স্বাস্থ্য আর  শিক্ষার সুবিধা। সমগ্র বিশ্বে অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বর্তমানে একশত কোটিরও বেশি। এমনকি অনেক মানবসন্তান আছে যারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছে না। বিশেষ করে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে এমনি অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যাই সর্বাধিক। আর সারা বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ শিশু অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় ।

 

বাংলাদেশে শিশুদের সুযোগ :

বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ। তাই এ দেশের শিশুরা বহু অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ দেশে রচিত হয়নি। অধিকাংশ শিশুই দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকার। দারিদ্র্যের কারণে বিপুল সংখ্যক শিশুকে জীবিকার তাড়নায় শ্রমদাসে পরিণত হতে হয়। তারা শিক্ষার সুযোগ পায় না। নির্মল আনন্দের সুযোগ থেকে হয় বঞ্চিত । অনেক শিশুকেই নিয়োজিত করা হচ্ছে অনৈতিক কাজে। সামাজিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সেবাও তারা পায় না । অনেকেই জীবন থেকে ঝরে পড়ে অকালে ।

 

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারি উদ্যোগ :

বাংলাদেশ সীমিত সম্পদের মাঝেও শিশুদের প্রতি নজর দেয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ, বিশ্ব শিশু সনদ মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে। ইতিমধ্যে ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি ঘোষিত হয়েছে। শিশুদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশকল্পে ১৯৭৬ সালে ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আইএলও কর্তৃক শিশুশ্রম রোধকল্পে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতা করছে।

গার্মেন্টসে শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারে ইতিমধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মজীবী মায়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি এবং ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগকে নিরুৎসাহিতকরণ, ছেলে ও মেয়ে শিশুদের সমান সুযোগ দান, শিশু মৃত্যুর হার রোধ, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার মতো কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার । তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।

 

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ :

শিশু অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সীমাহীন দারিদ্র্য প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনে বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া এক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতি অর্জিত হবে না। তবে শিশুদের যেন ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে এবং সুস্থ, সবল, শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে যথাসম্ভব গড়ে তোলা যায় সেজন্য বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার। এজন্য চাই অপচয় রোধ ও বিলাসিতা পরিহার করে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং দেশী-বিদেশী বেসরকারি সহযোগিতার সুষ্ঠু প্রয়োগ।

বিশ্ব শিশু দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার :

দেশে বিশ্ব শিশু দিবস উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালিত হলেও সার্বিকভাবে আমাদের শিশুদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও এখনো প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ শিশু স্কুলে যায় না । গ্রামের অধিকাংশ শিশুই অপরিণত বয়সে গৃহস্থালী ও মাঠেঘাটে কাজ করে থাকে । কলকারখানা ও বাসাবাড়িতে লক্ষ লক্ষ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। গার্মেন্টেসে শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করা হলেও এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। দেশের অধিকাংশ শিশু অপুষ্টি ও অনাহারের শিকার। এই চরম বাস্তবতার মধ্যেও আন্তর্জাতিক শিশু দিবস উদযাপন অনেক সময় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নিদারুণ পরিহাস বলেই মনে হয়।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment