বিশ্ব পরিবেশ দিবস রচনার একটা নমুনা তৈরি করি আজ। এই রচনাটি আমাদের “আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস রচনা
ভূমিকা :
মানব বাসের জন্য চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। শুধু মানব জীবনই নয় বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীর রক্ষাকা এই পরিবেশ। কাজেই জীবন এবং পরিবেশ এক ও অভিন্ন বিষয়। একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক মরা- বাঁচার। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হয়।
১৯৭২ সালের জুনে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশের ওপর প্রথম জাতিসং সম্মেলনে পরিবেশ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৭ তম অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । এরই সঙ্গে ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তা বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের ফলশ্রুতিতেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ।
বিশ্ব পরিবেশ :
পরিবেশ একটি ব্যাপক বিষয়। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই পরিবেশ। পরিবেশ যেহেতু ব্যাপক বিষয় সেহেতু পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রও অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। ওজোন স্তরের ক্ষয়, পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দদূষণসহ নানা দূষণের কারণে পৃথিবী নামক এই গ্রহটি মানববাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। তাই আজ সময় এসেছে বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার।
পরিবেশ দূষণের প্রধান ক্ষেত্র :
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে। যেমন— মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা, ঘর-বাড়ি, নদনদী, গ্রহ-উপগ্রহ, বায়ু, পানি ইত্যাদি সবকিছুই পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, আর্সেনিক দূষণ, মাটিদূষণ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, খাদ্যদূষণ, ওজোন গ্যাস হ্রাস ও গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া প্রধান।
পানিদূষণ :
পানিদূষণ নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্নতা প্রথম শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। শিল্প বিপ্লবের ফলে শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলার উপযুক্ত স্থান বেছে নেয়া হয় নিকটস্থ নদী বা খালকে। এরপর থেকে ক্রমাগত জৈব আবর্জনা, জীবাণুসমূহ, রাসায়নিক পদার্থ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, উষ্ণ পানি ও তেল পানিতে মিশ্রিত হয়ে প্রতিনিয়ত পানি দূষিত করছে।
বায়ুদূষণ :
প্রায় শতকরা ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন ও ২১ ভাগ অক্সিজেন সমন্বয়ে বায়ুমণ্ডল গঠিত। 1 এছাড়াও বায়ুতে কিছু পরিমাণ জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং হাইড্রোজেনও রয়েছে। বায়ুর এই মৌলিক উপাদানগুলো ব্যতীত অন্য কোনো কিছু যখন বায়ুতে মিশ্রিত হয় বা দূষিত কোনো পদার্থ সংমিশ্রিত হয় তখন বায়ুদূষণ ঘটে। মূলত বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, হাইড্রোজেন আলফাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, হাইড্রোকার্বনসমূহ, নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ, সালফারের অক্সাইডসমূহ, ওজোন স্তরের ক্ষতিকর বায়ুবাহিত কণাসমূহ, ফটো কেমিক্যাল অক্সিডেন্ট, অ্যাসবেস্টাস, পারদ, বেরিলিয়াম ইত্যাদি। তাছাড়া কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়াও বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে।
শব্দদূষণ :
বর্তমানে শব্দও দূষণ প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য উপাদান। যানবাহনের জোরালো হর্ন, কলকারখানার নির্গত শব্দ, নির্মাণ কাজের শব্দ, যান চলাচলের শব্দ, নির্বিচারে লাউড স্পিকারের শব্দ, উড়োজাহাজের শব্দ, প্রচণ্ড কলকোলাহল, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ফুড রেন্ডার, পাখা ইত্যাদির শব্দ পরিবেশ বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পায়। মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় ।
আর্সেনিক দূষণ :
আর্সেনিকের ল্যাটিন শব্দ আর্সেনিকাম (Arsenicum)। এর সংকেত হলো As এটি স্বতন্ত্র রাসায়নিক মৌল। শিলামণ্ডলে ও ভূ-ত্বকে আর্সেনিকের পরিমাণ প্রায় ৫-১০ শতাংশ, আর পাথরের উল্কাপিণ্ডে ২.১০০ শতাংশ। আর্সেনিক ও তার দ্রবণীয় যৌগ মিলে সাংঘাতিক বিষ সৃষ্টি করতে পারে। অজৈব আর্সেনিক বিষ থেকে ক্যান্সার হয়। মার্কিন বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা যায় পানি পানের মাধ্যমে চর্ম ক্যান্সারের প্রকোপের হার প্রতি দশ হাজারে একজন হবে যদি প্রতি লিটারে আর্সেনিক গ্রহণের মাত্রা ১.৭ মাইক্রোগ্রাম হয়। আর্সেনিকের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হিসেবে চমড়া, শ্বাসতন্ত্র, হার্ট, যকৃত, কিডনি, রক্ত, রক্ত উৎপাদনকারী অঙ্গসমূহ ও স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়ে থাকে।
মাটিদূষণ :
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নগরের আবর্জনা, শিল্প আবর্জনা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি মাটিদূষণের জন্য দায়ী।
পরিবেশ দূষণের কারণ :
পরিবেশ দূষণের প্রধান কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :
১. বন উজাড়করণ :
গাছপালা বাতাস থেকে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে বন উজাড় তথা বৃক্ষ নিধন করার কারণে বাতাসে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ছে। ফলে বায়ু হচ্ছে দূষিত।
২. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ :
অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু সে তুলনায় মানুষের মৌলিক প্রয়োজন যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না । ফলে জনসংখ্যার চাপে লোকালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
৩. শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য :
বিশ্বের সর্বত্রই অপরিকল্পিত কলকারখানা গড়ে উঠেছে। শুধু শিল্পনগরীতেই এসব কলকারখানা গড়ে উঠেছে তা নয়, যত্রতত্র এমনকি আবাসিক এলাকা বা লোকালয়েও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বহু কলকারখানা। এসব কলকারখানা থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে দূষিত ধোঁয়া, যা বায়ুদূষণ করছে। তাছাড়া কলকারখানার পরিত্যক্ত বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থ ফেলা হচ্ছে রাস্তাঘাট ও নদীনালাতে, যা পানি দূষিত করছে।
৪. রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার:
অপরিকল্পিত ও ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ প্রভৃতি কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হয়। এগুলোও পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে।
৫. পারমাণবিক বিস্ফোরণ :
পরাশক্তিগুলোর অব্যাহত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে।
৬. ওজোন স্তরের ক্ষয় ও তার প্রতিক্রিয়া :
ওজোন স্তরের ( Ozone Layer) ক্ষয় বলতে বোঝায় ওজোন স্তরে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ কমে যাওয়া। ওজোন স্তর থাকায় ক্ষতিকর বিভিন্ন রশ্মি থেকে বিশ্ববাসী রক্ষা পাচ্ছে। যেমন সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত যে আলোকরশ্মি পতিত হয়, তার মধ্যে ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও রয়েছে। এই আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি বা অতিবেগুনি রশ্মি জীবজগতের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
বায়ুমণ্ডলে পৃথিবী পৃষ্ঠের ১১ কিলোমিটার ওপর থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে স্ট্রাটোস্ফিয়ার (Stratosphere) বলে । স্ট্রাটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা মাইনাস ৫৬ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্ট্রাটোস্ফিয়ার-এর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে বলে এখানে ধনাত্মক ল্যাপস রেট (Lapse rate) বিরাজ করে। এই স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওপরের স্তর হচ্ছে ওজোন (O3) স্তর। ওজোন স্তর পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার ওপরে ২.৫ থেকে ৩ কিলোমিটার পুরু ওজোন গ্যাস (Og) নির্মিত স্তর। ওজোন স্তরে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব ১০ পিপিএম। বাতাসে ওজোন ও অন্যান্য ট্রেস গ্যাসের পরিমাণ আয়তন অনুসারে ০.০, ১ থেকে ০.০৪ শতাংশ।
সূর্য থেকে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যে আলোকরশ্মি পতিত হচ্ছে তার মধ্যে ২২০ থেকে ৪০০ ন্যানোমিটারের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আলট্রাভায়োলেট (Ultraviolet-UV) রশ্মি জীবজগতের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ওজোন গ্যাস ক্ষতিকর এই আলট্রাভায়োলেট রশ্মিকে অতিমাত্রায় গ্রহণ করে। আর এর জন্যই ওজোন স্তর জীবজগতের জন্য নিরাপদ বেষ্টনী হিসেবে কাজ করছে এবং ওজোনকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর অদৃশ্য বন্ধু বলা হয়। ওজোন স্তর ঘাতক আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মির শতকরা ৯১ ভাগই শোষণ করে। ওজোন গ্যাস ২২০ থেকে ৩৩০ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের হাইলিভায়োলেট রশ্মি গ্রহণ করে অক্সিজেন অণু ও জায়মান অক্সিজেন তৈরি করে ।
ওজোন স্তরের ওজোন গ্যাস ক্ষয়প্রাপ্ত হলে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি বিনা বাধায় পৃথিবীতে পতিত হবে। এতে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাবে ভূ-পৃষ্ঠ মানববাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বর্তমানে বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীর খামখেয়ালি ও পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে ওজোন স্তর বেশি ক্ষরা হচ্ছে। ওজোন স্তরের ক্ষয়কারী পদার্থের মধ্যে সিএফসির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ওজোন স্তরের ক্ষয়ে সক্রিয় অন্যান্য পদার্থের মধ্যে রয়েছে হাইড্রোক্লোরাফ্লোরা কার্বনসমূহ, কার্বন টেট্রা ক্লোরাইড, মিথাইল ব্রোমাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্ম এবং হ্যালোজেনসমূহ ।
সিএফসি মূলত ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রনিক সার্কিট পরিষ্কার করতে, ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনারের শীতলীকারক হিসেবে, ওষুধ স্প্রে করার বোতলে, ফাস্ট ফুড প্যাকেট তৈরিতে এবং ফোমের গদিসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে। এছাড়াও জেট ইঞ্জিন, মোটরযান, রকেট, সুপারসনিক বিমান এবং কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে বাতাসে সিএফসি নির্গত হচ্ছে। সিএফসি গ্যাস বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৭৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এরপর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তা ভেঙ্গে গেলে ক্লোরিন হাইড্রোক্লোরিক এসিডে পরিণত হয় এবং এসিড বৃষ্টি হিসেবে পৃথিবীতে নেমে আসে। ১৯৮৫ সালের দিকে প্রথমে ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কথা জানা যায়। ওজোন স্তরের সবচেয়ে বেশি ক্ষয় হয়েছে আর্কটিকের কাছে উত্তর গোলার্ধে। সেখানে এ স্তর কোথাও কোথাও এত পাতলা হয়ে গেছে, যাকে বিজ্ঞানীরা Ozone Hole বলে অভিহিত করেছেন।
বর্তমানে কুমেরুর আকাশে ৫০-৬০ ভাগ ওজোন নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবীর তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে। ফলে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হবে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে এবং সমুদ্রের পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস দেখা দেবে। হারিয়ে যাবে কিছু বিখ্যাত বন্দর। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলের অধিকাংশ বেলাভূমি, চীনের কিছু অংশ, মালদ্বীপের ‘সিংহভাগ ভূ-খণ্ড, সিসেলিস, কুক ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জসহ নিম্নাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বিশ্বের মানচিত্র থেকে। ঘরবাড়ি, জমি-ফসল হারিয়ে ১২ কোটির বেশি লোক উদ্বান্ত হয়ে পড়বে।
তাছাড়া ওজোন স্তর ধ্বংসের কারণে পৃথিবীতে ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে ২ শতাংশ । অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ইতিমধ্যে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষ মেলানোমা ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। চোখে ছানি পড়া রোগীর সংখ্যা বাড়বে ০.৫ শতাংশ। এছাড়া ছানিপড়া রোগীদের মধ্যে অন্ধত্ব বেড়ে যাবে। দেহের ইম্যুনতন্ত্র (Immune system) বিধ্বস্ত হবে। ফলে দেহ সহজেই সংক্রমণশীল রোগ-জীবাণুর কাছে পরাভূত হবে অর্থাৎ রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাবে।
উদ্ভিদে ক্লোরোফিলের পরিমাণ হ্রাস পাবে। ফলে উদ্ভিজ্জ উৎপাদন কমে যাবে। মিউটেশনের হার বৃদ্ধি পাবে। খাদ্যাভাবে মাছের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। মাছ, পতঙ্গ ও উভচরের ডিমে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার ফলে এসব প্রজাতির বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হবে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও বনভূমি ধ্বংস হবে। বিশ্বময় উষ্ণায়নের গতি বেড়ে যাবে এবং ফাইটোপ্লাংটন ধ্বংসের মধ্য দিয়ে মহাসাগরীয় খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙ্গে যাবে। ফলে এ শৃঙ্খলে অবস্থিত সমুদয় প্রাণীগোষ্ঠীর বিলোপ ত্বরান্বিত হবে।
৭. গ্রিন হাউস ইফেক্ট :
গ্রিন হাউস শব্দের আক্ষরিক অর্থ সবুজ ঘর। আর গ্রিন হাউস ইফেক্ট অর্থ সবুজ ঘর প্রতিক্রিয়া। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবী নামের গ্রহটি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। দক্ষিণ গোলার্ধে ওজোন স্তরের ফাটল দিয়ে বিনা বাধায় ঢুকছে ক্ষতিকর বিভিন্ন রশ্মি। এখানে সেখানে হলুদ বৃষ্টি ও বাতাসে ক্লোরাফ্লোরো-কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সবুজ বনাঞ্চল, গলে যাচ্ছে ইউসেমিটি পর্বতের শুভ্র তুষার।
কলকারখানার ধোঁয়া, জ্বালানি শক্তি দহন, অধিক জনবসতি ইত্যাদি কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। তাছাড়াও বিভিন্ন রাসায়নিক ও জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হচ্ছে ক্ষতিকর মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন গ্যাস ইত্যাদি। এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে এবং সৃষ্টি করছে একটি দুর্বোধ্য স্তর, যার ফলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নির্গত তাপ ওপরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ফিরে আসছে পৃথিবীর দিকে। এ অবস্থাকে বলা গ্রিন হাউস ইফেক্ট।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব:
জনসাধারণকে সচেতন করে মনুষ্য বাসোপযোগী অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গুরুত্বও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কিত এ দিনটি তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতার দিন নয়। শুধু বক্তৃতা বা আলোচনাও এর একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমাদের উচিত, দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা। আমাদেরকে পরিবেশ দূষণমুক্তির নতুন উপায় উদ্ভাবনে ব্রতী হতে হবে।
এতে শুধু সরকারই নয়, দেশের সচেতন জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। স্বার্থান্বেষী পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের অবিমৃশ্যকারিতার ফলে সমগ্র প্রাণিজগতে যে ভয়াবহ বিপদের সূচনা হয়েছে, তার প্রতিকার -প্রতিরোধ করতে না পারলে খুব শীঘ্রই মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনরিতে জাতিসংঘ ও পরিবেশ উন্নয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। এতে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের ১০ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। উক্ত সম্মেলনে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৪৭টি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় কিয়োটা প্রটোকল ।
কিন্তু বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পরিবেশ দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কিয়োটা প্রটোকলে সাক্ষর করেনি। সুতরাং পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হলে ব্যাপক ও সুচিন্তিত কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা কার্যকর করতে হবে। আজ ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, উন্নত, অনুন্নত সব দেশকেই সমবেত উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষায় ব্রতী হতে হবে। ভয়াবহ এ পরিবেশ দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ দিবস উদযাপনের আহ্বান নয়, তাকে শ্যামল সবুজ করে তোলা- এ হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি :
জাতিসংঘ প্রতি বছর এ দিবসটিতে পরিবেশ সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষকে সজাগ হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এ লক্ষ্যে দেশে দেশে নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতি বছরই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে সম্পত্তি। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, খরা, কন্যা একের পর এক লেগেই রয়েছে। অবশ্য পরিবেশবিজ্ঞানীরাও থেমে নেই। তারা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ধ্বংসের এ তাণ্ডবলীলার মাত্রা কিভাবে কমিয়ে আনা যায়।
জাতিসংঘ ঘোষিত পরিবেশ দিবসের আলোচ্যসূচিতে দুর্যোগকবলিত মানুষের জানমালের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। প্রকৃতিক দুর্যোগের আগাম সংবাদ দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়ার ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ১০১তম মার্কিন কংগ্রেসের অন্যতম অগ্রাধিকারভিত্তিক বিল হচ্ছে ‘ক্লিন এয়ার বিল’। অস্ট্রেলিয়ার সরকার বিপুল সংখ্যক বৃক্ষরোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটেনে পরিবেশ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। রোম, স্কটল্যান্ড বা লন্ডনের শহরতলির শিল্প এলাকায় সরকার নিয়মিত বৃক্ষরোপণ করে। এতে দূষণের পরিমাণ কমছে। গাছগুলো দ্রুত বড় হয় এবং কার্বন-ডাই অক্সাইড সমেত কলকারখানার বর্জ্য গ্যাস শুষে নেয়।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বাংলাদেশ :
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হয়। পরিবেশ দূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকার ‘পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। তারপরেও পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখনো এ দেশের মানুষের মধ্যে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। পরিবেশ রক্ষায় এ দেশের মানুষ উদাসীন। তাই অবাধে চলছে বৃক্ষনিধন। যত্রতত্র কল-কারখানা গড়ে উঠছে।
ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে, পানিতে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিত করতে দূষণমুক্ত পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- অরণ্য ধ্বংস বন্ধ করা, ভূমিক্ষয় রোধ করা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে, তার পরিবর্তে মাত্র ৫০ শতাংশ ভূমিতে বৃক্ষরোপণের কাজ হচ্ছে। বাকি অর্ধেক পরিণত হচ্ছে বিরাণ ভূমিতে । ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি :
দেরিতে হলেও বাংলাদেশে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ছে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ‘পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়’ নানা অনুষ্ঠানসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করছে এবং এর গুরুত্ব জনগণের মাঝে তুলে ধরছে। বলা হচ্ছে পরিবেশ রক্ষায় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতার কথা। দিবস উপলক্ষে র্যালি, সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন ছাড়াও প্রচার মাধ্যমে গণসচেতনতামূলক ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় । এতে জনগণের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে।
উপসংহার :
উন্নয়নের সাথে পরিবেশ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সাম্প্রতিক এ উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াসকে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী আজ সেই চেতনার ফলশ্রুতি বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্ব পরিবেশ দিবস জাতীয় জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবসটি এসে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। বিশ্ব অনুভব করে পরিবেশ সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা । পরিকল্পিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয় । এ দিনে সকল দেশের মানুষ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয় ।
আরও দেখুন: