আজ আমাদের প্রবন্ধ রচনায় বিষয় – বাংলার লোকসাহিত্য, বা বাংলাদেশের লোকসাহিত্য, বা লোকসাহিত্য ও আমরা, বা পল্লীসাহিত্য। আমরা নমুনা তৈরি করে দিচ্ছি। আপনারা চর্চা করে নিজের মতো করে লিখুন।

Table of Contents
বাংলার লোকসাহিত্য :
ভূমিকা:
আমরা প্রকৃতির সন্তান। বিশাল আকাশ আমাদের ঘরের ছাদ। আর বায়ুসাগরের মধ্যে আমরা আছি। তবুও আমাদের অনেক সময়ই থাকে না, আমাদের বাতাস। পণ্ডিত বহুভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সঙ্গত কারণেই একবার লোকসাহিত্যকে বাতাসের সাথে তুলনা করেছিলেন। বাতাস যেমন আমাদের আছে, তেমনি আমাদের চারপাশে আছে লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য বাতাসের মতোই উদার সীমাহীন। আমরা লোকসাহিত্যকে মনে রাখলেও লোকসাহিত্য রেখেছে।
লোকসাহিত্য কী :
এক কথায় সাধারণ মানুষের মনের কথা, মুখের কথা ভাষা ও ছন্দে বাণীবদ্ধ হয়ে লোকমুখে তা প্রচারিত ও প্রচলিত হয়ে সাহিত্য হয় তাকে লোকসাহিত্য বলে। জনৈক সমালোচক বলেন, সাহিত্য লেখা হয়নি তালপাতার মূল্যবান গাত্রে, যে পায়নি সমাজের উচুতলার লোকদের সমাদর, যে সাহিত্য পল্লীর সাধারণ মানুষের কথা বলেছে গানে, সাহিত্যের রচয়িতার নামও গেছে, বলা হয় লোকসাহিত্য। সাহিত্য সাধারণ মানুষ পল্লীর আলোছায়া, ভালোবাসা ও স্মৃতিকে সম্বল বেঁচে আছে। আমরা অনেক ছড়া, গান, গীতিকা, গাঁথা পড়ি শুনি। কিন্তু সেগুলোর রচয়িতা কারা?
এগুলো অনেক দিন আছে পল্লীর মানুষের কণ্ঠে। কোন বেদনাময় কাহিনী আমরা না। কিন্তু এগুলো বেঁচে আছে চিরকাল। সুতরাং বলা যায়, সাহিত্য কোনো বিশেষ ব্যক্তিচিন্তা সাধনা থেকে উদ্ভূত না হয়ে মানুষের মনে আপনা থেকেই জন্মায়, যার মধ্যে কোনো তত্ত্বকথা উপদেশ নিহিত কিন্তু প্রাণের সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসি প্রভৃতির অনাড়ম্বর প্রকাশ ঘটে নিত্য পরিবর্তনশীল নদীস্রোতের মতো মানুষের মনে করে, তাকেই লোকসাহিত্য বলে। সাধারণ মানুষের মনের সহজ স্বচ্ছন্দ রূপায়ণ হলো লোকসাহিত্য। বাংলার লোকসাহিত্য বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়ধারার প্রতিচ্ছবি। কারণেই শাশ্বত বাঙালি জাতির সম্পদ—জাতির যুগ-যুগান্তরের হৃদয় ছবি।
![প্রবন্ধ লেখা, বাংলা প্রবন্ধ, প্রবন্ধ লেখার বিন্যাস, প্রবন্ধ লেখার উদাহরণ, সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখা, বাংলায় কীভাবে একটি প্রবন্ধ লিখতে হয়, প্রবন্ধের বিষয় [ Essay writing, Bangla Essay, Essay writing format, Essay writing examples, Short essay writing, How to write an essay in Bangla, Essay topics ]](https://banglagurukul.com/wp-content/uploads/2022/03/Essay-writing-English-essay-Essay-writing-format-Essay-writing-examples-Short-essay-writing-How-to-write-an-essay-in-English-Essay-topics-146-300x169.jpg)
বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিকথা:
বাংলা লোকসাহিত্যের ইতিহাস এর ঐতিহ্য হাজার বছরের। বাংলা ভাষা সৃষ্টির প্রাথমিক যুগেই লোকসাহিত্যের হয়। লিখিত সাহিত্যের নির্দিষ্ট লেখক থাকে। লোকসাহিত্যের কোনো সুনির্দিষ্ট লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় না। মনে যেন সারা সমাজ একসাথে বসে নিজেদের মনের কথা গানের সুরে বলেছে। তা লেখা হয়নি কাগজে তালপাতায়। তবে তা লেখা হয়েছে মানুষের হৃদয়পটে। গ্রামের মানুষ গান, গাঁথা মনে রেখেছে এবং আনন্দ বেদনায় তা পেয়েছে। এভাবে বেঁচে আছে লোকসাহিত্য।
লোকসাহিত্যের সৃষ্টি ও বিকাশের রীতি বেশ চমৎকার। যেমন ছড়ার কথাই ধরা যাক। কখন যে কার মনে কোন ঘটনা দাগ কেটেছে এবং সে ঘটনা ছন্দলাভ করেছে তা আজ কারো মনে নেই। কিন্তু সে ছড়া একজনের কাছ থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা সমাজে। সমাজে যখন ছড়াটিকে ভালো লেগেছে, তখন সেটিকে মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে । এভাবে ছড়াটি হয়ে উঠেছে সমগ্র সমাজের সৃষ্টি। ফলে গীতিকার, লেখকের নাম পাওয়া যায় না। কেননা হয়তো তার কোনো নির্দিষ্ট কবি নেই।
অনেকের মনের কথা হয়তো জমাট বেঁধে একটি গীতিকায় রূপ পেয়েছে। আবার হয়তো কোনো এক কবি সত্যিই রচনা করেছিলেন গীতিকাটি রচনার পর সকলের সামনে গান করেন সেটি সকলের ভালো লাগে তা সমাজের সকল লোক সে গানটি মুখস্থ করে এবং মুখে মুখে গায় সেটি। এভাবে বহু বছর কেটে যায়।
কালের প্রবাহে গানটির রচয়িতার নামটি হারিয়ে যায়। তখন গীতিকাটি হয়ে ওঠে সারা সমাজের সৃষ্টি। কবির রচনাও কালের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বদলে যায়। হয়তো নতুন রূপে তা মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে শোভা পায়। এভাবে বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন পসরা—ছড়া, গীতি, গাঁথা, রূপকথা, উপকথা, ছড়াগান, গল্পকাহিনী, প্রবাদ, ধাঁধাঁ, লোকগাঁথা আরো অনেক কিছুই বাংলা লোকসাহিত্যকে বিকশিত করেছে।

লোকসাহিত্য যেভাবে সংগৃহীত হয়:
বাংলা সাহিত্যে লোকসাহিত্য বেশ ধনী। অফুরন্ত লোকসাহিত্য আছে আমাদের। পল্লীতে পল্লীতে, গ্রামে গ্রামে তা ছড়িয়ে ছিলো এবং আজও আছে। ভদ্র তথ্য সুখী সমাজ এর সংবাদ অনেক দিন জানতো না। কেননা লোকসাহিত্য লিখিত হয়নি। তা বেঁচে ছিল গ্রামের মানুষের মনে। তারাই ছিলো লোকসাহিত্যের লালন-পালনকারী। তারপর এক সময় আসে, যখন ভদ্রলোকদের দৃষ্টি পড়ে সেদিকে। শুরু হয় লোকসাহিত্য সংগ্রহ। বাংলাদেশের পল্লী ও গ্রামাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয় অনেক ছড়া, অনেক গীতিকা।
আমরা সেগুলোর স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য যাদের নাম বিখ্যাত তাদের মধ্যে চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯–১৯৪৬)। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের অধিবাসী। লোকসাহিত্যের প্রতি তার ছিল প্রবল অনুরাগ। তাই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন অনেকগুলো গীতিকা। তার সংগৃহীত গীতিকাগুলো সম্পাদনা করে ময়মনসিংহ গীতিকা (১৯২০) নামে প্রকাশ করেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন। দীনেশচন্দ্র সেন নিজে সংগ্রাহক ছিলেন না। কিন্তু তার ছিলো লোকসাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ। তিনি লোকসাহিত্যকে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় করে। তুলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লোকসাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তিনি সংগ্রহ করেছিলেন অনেকগুলো ছড়া। কেবল ছড়া সংগ্রহ করে তিনি থেমে যাননি। লোকসাহিত্যের উপর একটি অসাধারণ বইও তিনি লিখেছিলেন। বইটির নাম ছিল ‘লোকসাহিত্য’। এ বই লোকসাহিত্যকে জনপ্রিয় করতে অনেক সহায়তা করেছে।
রূপকথা সংগ্রহ করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭–১৯৫৭), উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১৮৬৩–১৯১৫)। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথা সংগ্রহের নাম ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদার ঝুলি’। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর রূপকথা সংগ্রহের নাম ‘টুনটুনির বই’। এছাড়া আছেন আরো অনেক সংগ্রাহক, যাদের সকলের চেষ্টায় আমরা পেয়েছি এক অপূর্ব লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার।
লোকসাহিত্যের পৃথিবী:
পল্লী তথা আমবাংলাই লোকসাহিত্যের পৃথিবী। বাংলার লোকসাহিত্য পল্লীবাংলার সাধারণ মানুষের হৃদস্পন্দন। এ সাহিত্য পল্লীর মানুষের আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছে ফুলের মতো। বেদনাকে বাজিয়েছে একতারার সুরের মতো। এখানে আছে সরল অনুভবের কথা, এ সরলতাই সকলকে মোহিত করে। লোকসাহিত্য তাই পল্লীর মানুষের বুকের বাঁশরী।
বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিঘাত, আনন্দ-বেদনায় পল্লীর নিরক্ষর অথচ সহজ-সরল মানুষ গানের আসর জমিয়েছে সাজিয়েছে প্রাণের বীণা। তাদের কর্মক্লান্ত অবসর মুহূর্তগুলো গ্রাম্য সুর মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। বুনো ফুলের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে মন মাতাল না হলেও তার বিহবল সৌন্দর্যে মন পুলকিত না হয়ে পারে না। তেমনি বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের আছে স্নিগ্ধ মায়াময় সৌন্দর্য ও প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। ভাই পল্লীসাহিত্য এত চিরন্তন আবেদনমুখর ও বৈচিত্র্যময়।
লোকসাহিত্যের কবিদের কোনো চিন্তা করার দরকার ছিল না, তারা অবলীলায় বলে যেতেন তাদের মনের কথা, হৃদয়ের কথা। সুর ও ছড়া-ছন্দের মধ্যেই তারা তাদেরকে ডুবিয়ে রাখতেন। তাই লোকসাহিত্যে পাওয়া যায় চমৎকার সহজ উপমা, সরল বর্ণনা, যাতে রয়েছে প্রাণের স্পর্শ ও আবেগের ছোঁয়া।

লোকসাহিত্যের বিষয় :
লোকসাহিত্য বড়ই বৈচিত্র্যময় ও চিত্তাকর্ষক। এর ভাণ্ডারও কিন্তু অনেক বড়, অনেক বিশাল। অনেক রকমের সৃষ্টি এখানে দেখা যায়। লোকসাহিত্যের বিষয় বা উপাদানকে নিম্নরূপ শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা:
১. ছড়া বা ছড়াগান, ২ গান বা গীতি, ৩. গীতিকা (Ballad) 8. ধাঁধা, ৫. রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, ৬. প্রবাদ, ৭. খনার বচন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১. ছড়া বা ছড়াগান :
ছড়া বা ছড়াগান লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ছড়া বড় মজার। বলতে গেলে সব বাঙালির সারাটা বাল্যকাল কাটে ছড়ার যাদুমন্ত্র উচ্চারণ করে। খুব কম লোকই আছে যাদের বাল্যকাল মাথা দুলিয়ে নেচে, খেলে, ছড়া কেটে বা ছড়াগান না গেয়ে কাটেনি। এসব ছড়া বা ছড়াগানে যাদু আছে। ছড়ার মধ্যে যেসব কথা থাকে, অনেক সময় সেসব কথার কোনো অর্থ হয় না বা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক পংক্তির অর্থ বোঝা যায়; কিন্তু পরের পংক্তির অর্থ বোঝা যায় না। ছড়া আসলে অর্থের জন্য নয় তা ছন্দের জন্য, সুরের জন্য। অনেক আবোল-তাবোল কথা থাকে এর মধ্যে এবং এ আবোল-তাবোল কথাই মধুর হয়ে ওঠে ছন্দের তালে। এরূপ একটি ছড়া হচ্ছে
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঝাবার কাসর মদঙ্গ বাজে।
এ পংক্তি দুটোর মধ্যে কথার তেমন অর্থ না থাকলেও এর ছন্দ ও তালে আমরা মাতাল হই। ছড়ার কথায় কোনো অর্থ থাকে না এ কথাও পুরোপুরি সত্য নয়। ছড়ার অর্থ থাকে গভীর গোপনে। সে ধরা দিতে চায় না, কেননা তার অর্থটা বড় নয়। এরূপ একটি ছড়া যার ভেতর অনেক দুঃখ লুকিয়ে আছে, তুলে ধরা হলো :
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।
ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কি
আর কিছুকাল সবুর করো রসুন বুনেছি।।
এটি একটি ঘুমপাড়ানি ছড়া এবং পংক্তিতে পংক্তিতে আছে স্বপ্নময় ঘুমের আবেশ। কিন্তু এর ভেতর ছেঁড়া সুতোর মতো রয়েছে বর্গীদের অত্যাচারের কথা। বর্গী তথা মারাঠা দস্যুরা একসময় বাংলায় যে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করেছিল, তারই স্মৃতি ধরে রাখা হয়েছে এ ছড়ার মধ্যে। আবার সহজ-সরল আবেগময় ও আবেদনময়তায় ভরা শিশুদের ঘুমপাড়ানি ছড়া, যেমন—
ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি যেও
বাটা ভরা পান দিবো বসে বসে খেয়ো।
কিংবা,
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
এখানে গ্রামবাংলার সহজ-সরল মানুষের অতিথি আপ্যায়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। আবার রোদের সময় বৃষ্টি হলে গ্রামের বালক কিশোর দল ছড়া কাটে :
রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।
শিয়ালে বিয়া করে রে ছাতি মাথায় দিয়া।
কিংবা দল বেঁধে গেয়ে ওঠে:
শিয়াল বিয়া করে রে
ছাতি মাথায় দিয়া।
এরূপ হাজারো ছড়া রয়েছে, যা আমাদের লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে।
২. গান বা গীতি/ লোকসঙ্গীত :
লোকসঙ্গীত বা লোকগীতি বাংলা লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এসব লোকসঙ্গীতের মধ্যে গ্রামবাংলার আবেগ-অনুভূতি, তাদের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ লুকিয়ে আছে। এসব গানের সুরের মূর্ছনা এখনও আমাদের পাগল করে।
মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে
আমি আর বাইতে পারলাম না।
আবার বিরহের গান, যেমন—
বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না
কিংবা হালকা রসের গান –
বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম
দেখা পাইলাম না। বন্ধু তিন দিন-
এসব গান আমাদের মনকে নাড়া দেয়। এরপর রয়েছে বাংলার জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল, গাজীর গান। এগুলো লোকসাহিত্যের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরে এসব রচনা লোকচিত্তে আনন্দের সামগ্রী হয়ে রস যুগিয়ে আসছে।
৩. গীতিকা (Ballad):
গীতিকা লোকসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। গীতিকা ছড়ার মতো ছোটো নয়। গীতিকা আকারে অনেক বড়। এতে বলা হয় নরনারীর জীবন ও হৃদয়ের কথা। গীতিকাসমূহে একজন পুরুষ ও একজন নারীর হৃদয় দেয়া-নেয়ার বিষাদময় কাহিনী বর্ণনা করা হয়। গীতিকার নায়ক নায়িকারা পল্লীর গাছপালার মতো সরল সবুজ, তারা পরস্পরকে ছাড়া আর কিছু জানে না। এর ফলে গীতিকায় পাওয়া যায় চিরকালের কামনা-বাসনার কাহিনী। এসব গীতিকার মধ্যে ‘মহুয়া’, ‘দেওয়ানা মদিনা’, ‘মলুয়া’ উল্লেখযোগ্য। এগুলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকায়। বাংলা গীতিকা সাহিত্যের মধ্যে পড়ে
ক. নাথ গীতিকা, গোরক্ষ বিজয়, ময়নামতির গান।
খ. ময়মনসিংহ গীতিকা ও
গ. পূর্ববঙ্গ গীতিকা।
নাথ গীতিকাগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা কিংবদন্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে এগুলোর আখ্যানভাগে গতানুগতিকার পরিবর্তে নাটকীয় গতি ও দীপ্তি লক্ষ্য করা যায়। ময়মনসিংহ গীতিকায় গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন—
বাইদ্যার ছেড়ি উইঠ্যা যখন বাঁশে মারলো নাড়া
বইস্যা আছিল নইদার ঠাকুর উইঠ্যা অইল খাড়া।
এখানে প্রেমরসের অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। আবার নবযৌবন সমাগতা কন্যার চিত্রটি অশিক্ষিত পল্লীকবির কন্ঠে এখানে জীবন্ত ও একান্ত বাস্তব হয়ে উঠেছে—
ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন
লাজরক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন।
৪. ধাঁধা :
ধাঁধাও লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গ্রামবাংলার যুবক, কিশোর, আবালবৃদ্ধবণিতা অবসর সময়ে ধাঁধার আসর বসায়। বর্তমান আধুনিক শিক্ষিত সমাজে ধাঁধা যথেষ্ট সমাদৃত। এ সমস্ত ধাধার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা যাচাই করা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:
ধাঁধা : তিন অক্ষরে নাম যার জলে বাস করে, মাঝের অক্ষর কেটে দিলে আকাশেতে উড়ে।
উত্তর : চিতল, চিল । মাছ ও পাখি।
ধাঁধা : সবুজ বুড়ি হাঁটে যায়, হাঁটে গিয়ে চিমটি খায়।
উত্তর : লাউ।
এসব হাজারো ধাঁধা গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে, যা আজও মানুষকে আনন্দ দান করে।
৫. রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা :
বাংলা লোকসাহিত্যে রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। রূপকথাগুলো অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য ঘটনার বিবরণীতে পূর্ণ। এসব রূপকথার গল্পগুলোর মধ্যে রাজা-রানীর গল্প রাজকন্যা-রাজকুমারের গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, দৈত্য-দানবের গল্প উল্লেখযোগ্য। ডালিমকুমার, নীলকুমার-লালকুমার ও রাক্ষসের গল্প শুনতে ভালোই লাগে। কিশোর কিশোরীদের নিকট এসব গল্প বড়ই প্রিয়।
বাংলার উপকথাগুলোতে পশুপাখির চরিত্র অবলম্বনে রস ও রসিকতার সাহায্যে উপদেশ ও নীতি শিক্ষাদান এবং ব্রতকথাগুলোতে অন্তঃপুরবাসী মহিলাদের দ্বারা লৌকিক দেবদেবীর উদ্দেশ্যে মাহাত্ম্যগান রচিত হয়েছে। ব্রতকথাগুলো এক সময় বাংলার লোকসমাজে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অনেকে মনে করেন, এ ব্রতকথাগুলো বাংলার আদিম কাব্য। এগুলোতে বাংলার লোকসাধারণের ধর্ম ও কর্মের পুরাতন ইতিহাস তার ক্ষীণরেখায় বিধৃত হয়েছে।

৬. প্রবাদ বা প্রবচন :
প্রবাদ বাংলা লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’, ‘সবুরে মেওয়া ফলে’, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’–এসব হাজারো প্রবাদ বাংলা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রবাদের কথাগুলো যথেষ্ট তাৎপর্যময়, অর্থবহ; এতে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিদীপ্তির পরিচয় মিলে।
৭. খনার বচন :
বাংলার লোকসাহিত্যে খনার বচন এক অমূল্য সম্পদ। প্রাচীন বাংলার মানুষ এসব বচনগুলো মেনে চলতো। যেমন—
কলা রুয়ে না কেটো পাত—তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
যদি বরষে আগনে, রাজা যায় মাগনে।
যদি বরষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ,
কার্তিকের উনো জলে
দুনো ধান, খনা বলে।
এসব খনার বচনগুলোতে প্রাচীন বাংলার জ্ঞানী-গুণীদের অভিজ্ঞতার পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এসব ছাড়াও বাংলা লোকসাহিত্যে রয়েছে অজস্র সম্পদ। যেমন—হেয়ালী, আর্য-তার্জা, ডাক ইত্যাদি। বাংলা লোকসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা তার মঙ্গলকাব্য, পাঁচালী, বাউলগান, টপ্পা, শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এগুলো কাব্যসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত হলেও মৌখিকভাবে এগুলোর পরিবেশন বাঙালির হৃদয়মনকে আকর্ষণ করেছিল। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকে বাংলার লোকসংস্কৃতিতে যাত্রা, পালাগান, কবিগান প্রভৃতির ধারা অব্যাহত ছিল। পল্লীর অশিক্ষিত নিরক্ষর সম্প্রদায় এগুলো পরিবেশন করে আনন্দ উপভোগ করত। এগুলোর স্বাদ যেমন অভিনব, রস পরিবেশনও তেমনি বিচিত্র প্রকৃতির।
লোকসাহিত্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা :
আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বনাশা স্রোতে বাংলার লোকসাহিত্য বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ এখনও পল্লীপ্রধান ও গ্রামনির্ভর। সুতরাং এ সাহিত্যকে ও এর অমূল্য সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। বিদেশে এসব সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য Folklore Society গঠিত হয়েছে। আমাদের দেশেও সাহিত্য প্রেমিকদের এ ব্যাপারে কর্মতৎপর হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদেরকে বাংলার লোকসাহিত্যকে ধ্বংসের মুখ থেকে উদ্ধার করতে হবে এবং এদেরকে বাঁচিয়ে রাখার সময় এসেছে।
উপসংহার:
বাংলার লোকসাহিত্য আজ আর সে পূর্বতন অবিচ্ছিন্ন ধারায় নেই। আধুনিক ও বিদেশী সভ্যতায় মোহান্ধ হয়ে আমরা আমাদের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত জীবনধারাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। এখন আর কর্মক্লান্ত দিনের শেষে পল্লী মায়ের কোলে পল্লীজননীর আঁচল পেতে গানের আসর বসে না। সন্ধ্যার পর বৈদ্যুতিক আলোয় সিনেমার আসর বসে আর স্যাটেলাইটের প্রভাবে তারা মাতাল হয়। আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও জীবনধারা থেকে হারিয়ে যাচ্ছি। কে এদের রক্ষা করবে? পূর্বাকাশে কালো মেঘ জমেছে। তবুও আমরা আশায় বুক বেঁধেছি হয়তো একদিন মেঘ কেটে যাবে। কালো মেঘে ঢাকা আমাদের লোকসাহিত্যকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন শুধু এর সংরক্ষণ ও অনুশীলন।
আরও পড়ুন:
বাংলা রচনা লিখন, প্রবন্ধ রচনা – সূচি