জীবন রক্ষায় রক্তদান নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি আমাদের “বাংলা রচনা সম্ভার” সিরিজের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” বিভাগের একটি রচনা। রচনা মুখস্থ করার বিষয় নয়। এই নমুনাটি নিয়ে আপনি নিজের মতো চর্চা করুন। তারপর নিজের মতো করে লিখুন।
Table of Contents
জীবন রক্ষায় রক্তদান
ভূমিকা :
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে— বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। দুঃস্থ মানবতার পাশে দাঁড়ানো প্রকৃত মানুষের স্বভাবধর্ম। এমন মানুষ চিরকাল আত্মত্যাগের মন্ত্রে মানুষকে দিয়েছে মহিমান্বিত আসন। যুগে যুগে এরাই ক্ষুধিতকে দিয়েছে অন্ন, নিরাশ্রয়কে দিয়েছে আশ্রয়, দুর্গতকে দিয়েছে ত্রাণ। তাই যুগে যুগে কাব্যগাথায় উচ্চারিত হয়েছে মানবসেবার জয়গান। অন্যের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় ‘রক্তদান’ আজকের দিনে রচনা করেছে মানবসেবার নতুন অধ্যায় ।
মানবদেহে রক্তের অপরিহার্যতা :
রক্ত শরীরের অপরিহার্য উপাদান প্রাণশক্তির উৎস। রক্ত আমাদের দেয় প্রাণের উষ্ণতা, দেয় জীবন শক্তি। শরীরে রক্ত থাকলেই মানুষ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তের অভাব ঘটলেই টান পড়ে প্রাণশক্তিতে । শরীরে রক্তাল্পতা বা রক্তশূন্যতা ঘটলে শরীর হয়ে পড়ে অসুস্থ। দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণে শরীর রক্তহীন হয়ে পড়লে ঘনিয়ে আসে মৃত্যু। রক্তে ক্যান্সার বাসা বাঁধলেও অকালে ঘনিয়ে আসে অনিবার্য মৃত্যু। কিন্তু বিজ্ঞান আজ আবিষ্কার করেছে, রক্তাল্পতা বা রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত মানুষের দেহে রক্ত দিতে পারলে আর্ত মরণাপন্ন মানুষ আবার সজীব হয়ে ওঠে নতুন প্রাণশক্তি পেয়ে। তাই বিপন্ন মানুষের রক্তের প্রয়োজনে মানুষ ছুটে আসে মানুষের কাছে। সুস্থ মানুষ তার দেহের রক্ত দিতে এগিয়ে আসে অকালে ঝরে যাওয়ার হাত থেকে অন্যকে বাঁচাতে।
মানবদেহে রক্তদানের গুরুত্ব :
রক্তশূন্য রোগী কিংবা দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণে মরণাপন্ন রোগীর দেহে রক্ত সঞ্চালন ছাড়াও আজকাল শল্যচিকিৎসায় রক্তসঞ্চালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বড় ধরনের যে কোনো অপারেশনে এবং যেসব অবস্থায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় সেসব ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে রক্ত ভরাণ ও সঞ্চালন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন- হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের দীর্ঘক্ষণব্যাপী অস্ত্রোপচার, অস্থিমজ্জা ও যকৃৎ প্রতিস্থাপন এবং ক্যান্সার চিকিৎসায় অপরিহার্যভাবে রক্তসঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। জটিল ডেঙ্গুজ্বরের মতো রোগে যখন সরাসরি রক্তে অনুচক্রিকা সঞ্চালন করতে হয় তখন তার জন্য রক্তদান ও রক্ত ভরণের কোনো বিকল্প নেই।
রক্তদান মহৎ কর্ম :
দেশ ও সমাজের মহৎ কর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম মহৎ কর্ম হলো রক্তদান। ব্যক্তির স্বেচ্ছায় দেয়া রক্তের বিনিময়ে একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষা পায় । এভাবে রক্তদান দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাছাড়া শিক্ষা ও সেবার মান উন্নয়ন ও গণসচেতনতার কারণে রক্তদান এ যুগে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সে সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও রক্তদান কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশবাসীকে রক্তদানের মতো মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করছে। সুতরাং রক্তদানের সকল পদক্ষেপই মহৎ কর্মের অন্তর্ভুক্ত।
রক্তদানের নিয়ম :
এক দেহের রক্ত অন্য দেহে সঞ্চালনের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের রক্ত পেলেই তা রোগীর শরীরে সঞ্চালন করা যায়। রক্তদাতাকে সুস্থ-সবল এবং ১৮-৫৭ বছর বয়সী হতে হবে। দাতার শরীরের তাপমাত্রা হতে হবে ৯৯ ডিগ্রির নিচে। রক্তচাপ থাকতে হবে ১০০/৬০ থেকে ২০০/৯০-এর মধ্যে রক্তদাতাকে হতে হবে জটিল রোগমুক্ত । রক্তদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একজন চিকিৎসের তত্ত্বাবধানে। একজন সুস্থ মানুষ প্রতি তিন’ মাস অন্তর অন্তর রক্ত দান করতে পারে।
রক্তদান সম্পর্কে অমূলক ধারণা :
আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান জনপ্রিয় নয়। কিছু পেশাদার রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত রক্তদান করে থাকে। কিন্তু এসব পেশাদার রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এদের মধ্যে প্রায় সবাই নেশাখোর এবং বিভিন্ন সংক্রামক ও মরণব্যাধিতে আক্রান্ত ।
তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রক্তদান সম্পর্কে অনেকের মধ্যে অমূলক ধারণা বিদ্যমান। রক্তদানের কথা শুনলে অনেকেই ভয়ে চমকে ওঠেন। অনেকে মনে করেন, রক্তদান স্বাস্থ্যহানি ঘটায় । এসব ধারণা নিতান্তই অমূলক । আমাদের দেহে প্রতিদিন রক্ত সৃষ্টি হচ্ছে এবং পুরানো রক্ত অকেজো হয়ে পড়ছে। রক্ত না দিলেও স্বাভাবিক নিয়মে রক্তের অকেজো হয়ে যাওয়াকে কেউই ঠেকাতে পারে না। প্রতি তিন মাস অন্তর যে কোনো সুস্থ-সবল মানুষ রক্ত দান করতে পারেন এতে স্বাস্থ্যহানির কোনো আশঙ্কাই নেই ।
রক্তদান ও রক্ত সংরক্ষণ :
অন্যের জীবন বাঁচাতে রক্তদান করা শুভচেতনাসম্পন্ন যে কোনো লোকই এখন মহৎ কর্তব্য বলে মনে করে। মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচাতে রক্তদান করতে ছুটে যায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ছাত্র-যুবক, নারী-পুরুষ যে কোনো সেবাব্রতী সচেতন মানুষ। রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে ব্লাড ব্যাংক। আপন ভাইবোন, বাপ-মা, ছেলে-মেয়ে যে কোনো স্বজন রক্তদান করতে পারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে। সাধারণভাবে ১৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী সুস্থ-সবল দেহের অধিকারী যে কোনো লোকই রক্তদান করতে পারেন। তবে রক্ত গ্রহণ করার আগে রক্তে সংক্রমিত রোগের জীবাণু আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হয়।
এ ছাড়া রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ ও সঠিক পন্থায় রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে । সুস্থ-সবল ও নীরোগ দেহ থেকে এককালীন ২৫০ সিসি রক্ত নেয়া যায়। এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। এ ক্ষতি পুষিয়ে যায় মাত্র সাত দিনে। রক্তাল্পতায় ভুগছেন না এমন সুস্থ লোক কোনো পরিকল্পিত অপারেশনের আগে ডাক্তারের অনুমোদন থাকলে প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ সিসি করে মোট ৪ সপ্তাহে ১৪০০ সিসি রক্ত প্রদান ও সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন আগে থেকেই। অপারেশনকালে ঐ রক্ত তিনি পুনরায় নিজের শরীরে ব্যবহার করতে পারেন। নিজের শরীরে নিজের রক্ত ভরণ সবচেয়ে নিরাপদ । কারণ, এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা এলার্জিজনিত সমস্যার আশঙ্কা থাকে না ।
রক্ত ভরণের ক্ষেত্রে সতর্কতা :
রক্ত ভরণের ক্ষেত্রে রক্ত গ্রহীতা এবং রক্তদাতাকে একই শ্রেণীর রক্তের অধিকারী হতে হবে। রক্তের গ্রুপ সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে গ্রহীতার রক্তে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন ক্ষেত্রে গ্রহীতার মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাছাড়া রক্তদাতার রক্তে কোনো সংক্রামক রোগের জীবাণু থাকলে কিংবা রক্তদান প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত সুচ, ব্যাগ ও সরঞ্জামাদি যদি ব্যবহৃত না হয় তবে রক্ত গ্রহীতাও ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, এইডস বা এমনি ধরনের কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন । তাছাড়া গরিব, অসুস্থ ও পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত প্রায়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এদের চেয়ে স্বেচ্ছায় দানকারীদের রক্ত অনেক বেশি নিরাপদ।
বাংলাদেশে নিরাপদ রক্তসঞ্চালন কার্যক্রম :
বাংলাদেশে নিরাপদ রক্তসঞ্চালন কার্যক্রম বর্তমানে মানবজীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কার্যক্রমের আওতায় বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল, সামরিক হাসপাতাল, সবগুলো জেলা হাসপাতালসহ দেশে মোট ৯৭টি হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ও সঞ্চালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি ও সংস্থা :
বর্তমানে নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে অগ্রণী ও জনপ্রিয় সংগঠন ‘সন্ধানী’। সন্ধানী স্বাস্থ্যখাতের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যার মাধ্যমে মানুষের রক্তের এবং অঙ্গের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক ও সমাজকর্মীর উদ্যোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজকে কেন্দ্র করে এটি প্রথম সংগঠিত হয় । দেশব্যাপী প্রধান শহরগুলোতে সন্ধানী এখন রক্ত সংগ্রহের কেন্দ্র পরিচালনা করে । বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে সন্ধানী নিয়মিত রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রথম সংগৃহীত রক্তকে কোনো নির্দেশক ভাইরাস যেমন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস- এর জন্য পৃথকীকরণ করা হয় এবং সংরক্ষণের পূর্বে তা শ্রেণীবিন্যাস করা হয় । রক্তদাতাগণ সন্ধানীতে এলে তাদেরকে একটি শনাক্তপত্র দেয়া হয়, যা তারা পরবর্তীতে যখন তাদের বা তাদের আত্মীয়- স্বজনদের রক্ত দরকার হয় তখন তারা সেটা উপস্থাপন করতে পারে। এই শনাক্তকরণ পত্রের সাহায্যে দেশব্যাপী সন্ধানীর সমস্ত কেন্দ্র থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রক্ত সংগ্রহ করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠান আলোচনা সভা, সেমিনার, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদানের ব্যাপারে জনগণকে অবহিত, সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করছে। এর ফলে স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসছেন সর্বস্তরের মানুষ ।
উপসংহার :
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের রক্তই লাল। তাই রক্তদান ঘুচিয়ে দেয় সাদা- কালোর ভেদ, ঘুচিয়ে দেয় ধর্মীয় ব্যবধান। রক্তদান তাই সর্বমানবিক এক মহান সেবাকর্ম। এক ব্যাগ রক্ত জীবন বাঁচাতে পারে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তির। এ প্রেক্ষাপটেই একুশ শতকের মানুষের কাছে প্রথম স্বাস্থ্যবার্তা : “জীবন রক্ষায় আমিই দেব নিরাপদ রক্ত। তাই নিরাপদ রক্ত দিতে এগিয়ে আসতে হবে, : বাঁচাতে হবে অমূল্য জীবন। সামিল হতে হবে ‘রক্ত দিন জীবন বাঁচান!’ আন্দোলনে ।
আরও দেখুন: