গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া -নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি আমাদের “বাংলা রচনা সম্ভার” সিরিজের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” বিভাগের একটি রচনা। রচনা মুখস্থ করার বিষয় নয়। এই নমুনাটি নিয়ে আপনি নিজের মতো চর্চা করুন। তারপর নিজের মতো করে লিখুন।

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া

ভূমিকা : মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রেক্ষিতে যার অবদানকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায় তা হলো বিজ্ঞান । বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিস্ময়করণ অবদানে মানব জাতি একদিকে যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করছে, অন্যদিকে তার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ সর্বনাশের দিকে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যাপক বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের পরিণামে বিশ্বের প্রকৃতি ও তার পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। এই ভারসাম্যহীতার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহটির সামনে এগিয়ে আসছে চরম দুর্দিন। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন গ্রিন হাউস ইফেক্ট।

মূলত গ্রিনহাউস ইফেক্ট পরিবেশ দূষণেরই একটি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া, যা বিশ্ববাসীকে এক নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বলাবাহুল্য, এর জন্য দায়ী মানুষ নিজেই । বিশ্ব স্রষ্টার নিখুঁত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতিকে মানুষ তার অবিমৃশ্যকারিতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে । প্রকৃতি হারিয়েছে তার ভারসাম্য, স্বাভাবিক গতি ও অনুকূল পরিবেশ।

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

গ্রিনহাউস বিষয়ক ধারণা :

সাধারণভাবে ইংরেজি Green House’ অর্থ ‘সবুজ ঘর’। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে এবং মেরু অঞ্চলের তীব্র শীতপ্রবণ এলাকায় বছরের একটি দীর্ঘ সময় সূর্যের অনুপস্থিতি থাকে। এ সময় মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীগণ বিশেষ ধরনের কাচের ঘর উদ্ভাবন করে। এ ঘরের ছাদ ও দেয়াল তাপ বিকিরণরোধী বিশেষ ধরনের কাচ দিয়ে তৈরি। গ্রীষ্মকালে এ ঘরে সূর্যালোক ও উত্তাপ প্রবেশ করে, কিন্তু বিকিরণ না ঘটায় তাপ বের হতে পারে না। তাই সঞ্চিত সূর্যতাপে বৈরি ও শীতার্ত পরিবেশেও শাকসবজি উৎপন্ন করা সম্ভব হয়। শীতের দেশে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক ঘরকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘গ্রিনহাউস’ বা ‘সবুজ ঘর’।

 

গ্রিনহাউস ইফেক্ট :

পৃথিবীকে ঘিরে এর চারপাশে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিমি পর্যন্ত রয়েছে ওজোনস্তর, তবে এর ঘনত্ব সব জায়গায় একই রকম নয়। ২৩ কিমি ঊর্ধ্বে ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম । এখানে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অপর কয়েকটি গ্যাসের এক বেষ্টনী। গ্যাসগুলোকে সমষ্টিগতভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস বলা হয়। এটি রাসায়নিক পর্দা হিসেবে কাজ করে।

গ্রিন হাউসের কাচের দেয়াল যেভাবে তার ভেতরের উষ্ণতাকে বাইরে বিকিরণ হতে বাধার সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনিভাবে বায়ুমণ্ডলে সৃষ্ট রাসায়নিক পর্দা বা গ্যাসের দেয়াল ভূপৃষ্ঠের শোষিত তাপের বিকিরণ ঘটাতে বাধা দেয়। গ্যাসের এ দেয়াল আছে বলেই কিছু পরিমাণ তাপ বাধা পেয়ে পৃথিবীতেই থেকে যায় এবং এর প্রভাবে বায়ুমণ্ডল উষ্ণ থাকে। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে যে উষ্ণতা থাকে তা জীবের পক্ষে বাসযোগ্য হয়। জীবের বসবাসের অনুকূল এ রূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় গ্রিন হাউস ইফেক্ট।

 

গ্রিন হাউস গ্যাস :

গ্রিন হাউস প্রভাব সৃষ্টিকারী গ্যাসগুলোকেই মূলত গ্রিন হাউস গ্যাস বলে। পূর্বে গ্রিন হাউস প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূলত কার্বন ডাই-অক্সাইডকে দায়ী করা হলেও, বর্তমানে জানা গেছে, পুরো সমস্যার ৫০%-এর জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং বাকি অর্ধেকের জন্য দায়ী অন্যান্য গ্যাসগুলো যেমন মিথেন ১৯%, সিএফসি ১৭%, ওজোন ৮%, নাইট্রাস অক্সাইড ৪% এবং জলীয় বাষ্প ২%। এসব গ্রিন হাউস গ্যাস যদি হঠাৎ বায়ুমণ্ডল থেকে উধাও হয়ে যায়,

তবে পৃথিবী রাতারাতি পরিণত হবে প্রাণহীন শীতল গৃহে। ফলে ডাইনোসরদের মতো অতিকায় প্রজাতির বিলুপ্তির মতো মানবজাতির ঘটবে করুণ বিলুপ্তি। তাই এ সকল গ্যাসের পরিমিত উপস্থিতি, পৃথিবীর স্বাভাবিক ও অনুকূল অস্তিত্বের জন্য খুব জরুরি। তবে লক্ষণীয় যে, শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে বহু শিল্প- কারখানা এবং যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া থেকে এ জাতীয় গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে।

 

ক. কার্বন ডাই-অক্সাইড:

বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসই পানির বাষ্পের পর সবচেয়ে কার্যকর গ্রিন হাউস গ্যাস। শিল্প বিপ্লবের কয়লা, তেল, গ্যাস ইন্ধন শক্তি দহন, বৃক্ষ নিধন বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাস সঞ্চয়ের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বর্তমানে ০.৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। আঠার শতকের শিল্প বিপ্লবের সূচনা থেকে বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাসের সঞ্চয় প্রায় ২২৫ শতাংশ বেড়েছে।

 

খ. মিথেন :

মিথেন গ্যাস প্রাকৃতিক গ্যাস যা বায়ুমণ্ডলে জৈব উৎস থেকে আসে। এই গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে। বিশ্বের জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ গ্যাসের সঞ্চলা মাত্রা বাড়ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের মাত্রা প্রতি দশ লাখ ভাগের ১.১ শতাংশ হারে বাড়ছে। গবাদি পশুর জাবর কাটা এবং ধান চাষের এলাকা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মিথেন গ্যাস বেড়ে চলেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস বাতাসে বেশি পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

 

গ. ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) :

সিএফসি গ্যাসগুলো হ্যালো কার্বন নামে পরিচিত একশ্রেণীর রাসায়নিক পদার্থের অংশ। হ্যালো কার্বন বায়ুমণ্ডলে ওজোন আক্রমণ করে ধ্বংস করে এবং গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান যোগায়। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাসগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ২০,০০০ গুণ বেশি তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে। এ গ্যাসগুলো বিভিন্ন ধরনের শিল্প উৎপাদকমূলক কাজে প্রধানত প্লাস্টিক ফোমের ফাঁপানোর উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে ও হিমায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে কাজ করে। এ গ্যাস ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ক্লোরিন ছাড়ে যা ওজোন ভাঙার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ওজোন স্তর পৃথিবীকে অতিবেগুনি রশ্মির কিরণ থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাসের সঞ্চয় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।

 

ঘ. ট্রাপোস্ফিয়ারিক ওজোন:

ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর পৃথিবীকে অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। নিচের বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাস তার আচরণ পরিবর্তন করে গ্রিন হাউস গ্যাস হিসেবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান তৈরি করে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ৬০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার ওজোনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে ১০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার মধ্যে অধিকাংশ  ওজোনের সমাবেশ ঘটে থাকে। মোটরগাড়ি ও শিল্প-কারখানা থেকে বের হওয়া হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ওজোন সৃষ্টি হয়।

 

ঙ. নাইট্রাস অক্সাইড :

নাইট্রাস অক্সাইড তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ১৫০ গুণ বেশি। মাটিতে অণুজীব ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রাস তৈরি হয়। বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের উপস্থিতি কম। তারপরও আশঙ্কার কারণ এ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নিজের অবস্থান একটা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে সক্ষম। উৎপাদন পদ্ধতির কারণে যে কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করে এই গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি বন্ধ করা গেলেও তা বহুদিন ধরে বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। বর্তমানে এ গ্যাস আনুমানিক ০.২৫ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে।

 

গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণ ও প্রক্রিয়া :

পৃথিবীকে বেষ্টনকারী আবহাওয়ামণ্ডলের কারণে এ ধরাধাম প্রাণ ধারণের উপযোগী হয়েছে। মহাশূন্যের আবহাওয়ামণ্ডলে ‘ওজোন স্তর’ নামে অদৃশ্য একটি বেষ্টনী বিদ্যমান । এ ওজোন স্তর পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ রোধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে। বিশ্ববাসীরই নানা কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্য ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস। এটা শিল্পকারখানাতেও ব্যবহৃত হয়। অবমুক্ত সিএফসি মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়কারী অন্যতম উপাদান ।

তাছাড়া গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, মানুষের মল-মূত্র প্রভৃতি থেকে ক্রমবর্ধমান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস। এগুলো বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে ইনফ্লায়েড রেডিয়েশনে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সূর্য থেকে আগত কিছু তাপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ধরে রাখে। এভাবে একদিকে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে প্রতিদিন সঞ্চিত হচ্ছে উত্তাপ। ফলে পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। অপরদিকে, পৃথিবী থেকে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ফলে বৃক্ষ কর্তৃক কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের হারও কমছে। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলেও ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

গ্রিন হাউস ইফেক্টের ফলাফল :

গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার কুফল গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে। এটা প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, বাস্তুসংস্থান করছে বিপর্যন্ত। পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১.৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কারণে তা এখন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ইতোমধ্যে উচ্চ তাপের কারণে মেরু অঞ্চলে কোটি কোটি বছর ধরে সঞ্চিত থাকা কোটি কোটি টন বরফ গলতে শুরু করেছে। পর্বতশৃঙ্গের বরফরাশিও গলছে। বরফ গলা এ পানি নেমে আসছে সমুদ্রে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশের মতো সমতল দেশগুলোর বিশাল অঞ্চল পানির নিচে চিরতরে তলিয়ে যাবে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ত্বক-ক্যান্সারসহ মানুষকে ভোগ করতে হবে জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে দাবানল সৃষ্টি হবে। সমুদ্রের স্রোত পরিবর্তিত হবে। সবুজ-শ্যামল বিভিন্ন দেশে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। অতি বন্যা, খরা, এসিড বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস পৃথিবীবাসীকে বিপন্ন করে তুলবে। মাংস হবে জীববৈচিত্র্য। ভেঙে পড়বে খাদ্যশৃঙ্খল। এভাবে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করবে।

 

বাংলাদেশে গ্রিন হাউস ইফেক্টের প্রভাব :

বাংলাদেশে গ্রিন হাউস ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিচে চিহ্নিত করা হলো :

 

১. ভূপৃষ্ঠের নিচু এলাকায় প্লাবন :

পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এতে সমুদ্রের অনেক দ্বীপ, উপকূলীয় অঞ্চল, সমুদ্র উপকূলের দেশ ও শহর পানিতে ডুবে যাবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাবে। এর ফলে অনেক জীবন এবং জীববসতি বিপন্ন হবে।

 

 ২. প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি:

সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এ বন কাঠ, বেত, মধু, মোমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস। এটা শিল্পের কাঁচামালেরও উৎস। এখানে আছে জীববৈচিত্র্য ও   দুর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণী, আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পরিবেশ ও ভূবিজ্ঞানীদের অভিমত, সমুদ্রের পানির উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বা ৩.৩৩ ফুট বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে ।

 

৩. লবণাক্ততার বিস্তার :

সমুদ্রস্ফীতির কারণে খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা প্রভৃতি জেলার আবাদি জমিতে সহজেই লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে এসব জেলার আবাদি জমি কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মানুষের ব্যবহার্য মিষ্টি পানির উৎস হারিয়ে যাবে। বিলুপ্ত হবে স্বাদু পানির প্রচলিত মৎস্য সম্পদ। এভাবে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশের কৃষি তথা বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

 

৪. বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস :

গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে সাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। নিম্নচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে অতি বন্যা ও দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘন ঘন দেখা দেবে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৮৮ সালের দু মাসব্যাপী বন্যায় দেশের ৫৩টি জেলাই প্লাবিত হয়েছিল।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, যা তিন মাস স্থায়ী হয়েছিল। ২০০৪ সালের বন্যা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। ১৯৯১ সালে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছিল ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। আমাদের দেশের অধিকাংশ বৃহৎ নদনদীর উৎস হিমালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকা। হিমালয়ের বরফ গলা পানির তীব্র স্রোত বাংলাদেশকে প্লাবিত করার সময় বহন করে আনছে প্রচুর মাটি, যা নদীর তলদেশ ভরাট করে তুলছে। এর ফলে মদনদীর জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং আবাদি জমি প্লাবিত হচ্ছে।

 

৫. আবহাওয়াগত বিপর্যয় :

আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এর বিশাল এলাকা ভবিষ্যতে অনুর্বর-নিষ্ফলা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিরাচরিত ঋতুচক্র ভেঙে যাচ্ছে, দেখা দিয়েছে অতি শীত এবং অতি গ্রীষ্মের দাপট। গ্রীষ্মকালে শীত এবং শীতকালে অকাল বন্যারও প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ক্রমশ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের এ দেশটিতে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, যা কৃষিসহ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 

৬. মরুভূমির বৈশিষ্ট্য :

গ্রিন হাউস ইফেক্ট ভূপৃষ্ঠের তাপ বৃদ্ধি পেলে মাটিতে পানির পরিমাণ কমে যাবে। ফলে সমগ্র ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে ইতিমধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। এতে ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে।

 

৭. এসিড বৃষ্টি :

গ্রিন হাউস ইফেক্টের ফলে আবহাওয়ামণ্ডলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এসব ক্ষতিকর অক্সাইডসমূহ বৃষ্টির পানির সাথে এসিড বৃষ্টি হিসেবে ভূপৃষ্ঠে পড়বে এবং ভূপৃষ্ঠের উর্বরতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাবে এবং বনাঞ্চলে এসিড বৃষ্টি হলে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে।

 

গ্রিন হাউস ইফেক্ট রোধে আমাদের করণীয় :

গ্রিন হাউস ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশে এ প্রতিক্রিয়ার অসহায় শিকার। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো বাংলাদেশকে এ সংকটের যতখানি কুফলভোগী করছে, সংকট সৃষ্টিতে আমাদের দেশের ভূমিকা তারচেয়ে নগণ্যই বটে। গ্রিন হাউস ইফেক্টের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে নিচে। বিষয়গুলোর দিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে : যেসব গ্যাস ভূমণ্ডলের উত্তাপ বাড়ায়, তাদের নির্গমন কমাতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যেমন—

ক. অযথা ঘরের বাতি জ্বালিয়ে না রাখা।

খ. রান্নার সময়টুকু ছাড়া গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখতে হবে।

গ. উন্নত চুলা ব্যবহার করলে জ্বালানি খরচ কমবে, গ্যাস নির্গমন হ্রাস পাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন করতে হবে। বনায়ন বাড়াতে হবে। কারণ গাছ ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে থাকে। গাছ অক্সিজেন দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। শিল্প কারখানায় যতটা সম্ভব জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে। পঁচাডোবা ও মজাপুকুর সংরক্ষণ করে মাছ চাষ করতে হবে। কারণ পঁচা পানিতে ক্ষতিকর গ্যাস উৎপন্ন হয় । সর্বোপরি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকলকে মানিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া | প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার :

পরিবেশ মানব সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তন ফসল । মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে যেমন কাজে লাগাচ্ছে বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে, প্রকৃতিও তেমনি ছিন্ন-ভিন্ন-আহত রূপ নিয়ে মানুষের তথা সমগ্র প্রাণপুঞ্জের ঠিক সমপরিমাণ বিরোধিতা করতে তৎপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। আজও করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতিকর সব আবর্জনা।

তার ফল হয়েছে বিষময়। পরিবেশ দূষিত হয়েছে। আর দূষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই গোটা জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই পরিবেশ আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে মহাবিপর্যয়ের দিকে। পরিবেশে দেখা দিয়েছে গ্রিন হাউস ইফেক্ট’। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে চিন্তা ভাবনার অন্ত নেই। পরিবেশের এই বিপর্যয়ের জন্য মূলত আমরাই দায়ী।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment