সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (জন্ম: ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪) অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। বিংশ শতকের শেষার্ধে আবিভুর্ত একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ সালে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক” ও “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি।
২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২৫ অক্টোবর ২০১২ তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
Table of Contents
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতাঃ
কবিতা লেখার চেয়ে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো লিবো এই ভাবনা
আরও প্রিয় লাগে
ভোর থেকে টুকটাক কাজ সারি, যেন ঘর ফাঁকা করে
সময়ে সুগন্ধ নিয়ে তৈরি হতে হবে
দরজায় পাহারা দেবে নিস্তব্ধতা, আকাশকে দিতে হবে
নারীর ঊরুর মসৃণতা, তারপর লেখা
হীরক-দ্যুতির মতো টোবল আচ্ছন্ন করে বসে থাকে
কালো রং কবিতার খাতা
আমি শিস দিই, সিগারেট ঠোঁটে, দেশলাই খুঁজি
মনে ফুরফুরে হাওয়া, এবার কবিতা একটি নতুন কবিতা…
তবু আমি কিছুই লিখি না
কলম গড়িয়ে যায়, ঝুপ করে শুয়ে পড়ি, প্রিয় চোখে
দেখি শাদা দেয়ালকে, কবিতার সুখস্বপ্ন
গাঢ় হয়ে আসে, মনে-মনে বলি, লিখবো
লিখবো এত ব্যস্ততা কিসের
কেউ লেখা চাইলে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, কাল দেবো, কাল দেবো
কাল ছোটে পরশু কিংবা তরশু কিংবা পরবর্তী সোমবারের দিকে
কেউ-কেউ বাঁকা সুরে বলে ওঠে, আজকাল গল্প উপন্যাস
এত লিখছেন
কবিতা লেখার জন্য সময়ই পান না।
বুঝি? না?
উত্তর না দিয়ে আমি জনান্তিকে মুখ মুচকে হাসি
ফাঁকা ঘরে, জানলার ওপার দূর
নীলাকাশ থেকে আসে
প্রিয়তম হাওয়া
না-লেখা কবিতাগুলি আমার সর্বঙ্গ
জড়িয়ে আদর করে, চলে যায়, ঘুরে ফিরে আসে
না-হয়ে ওঠার চেয়ে, আধো ফোটা, ওরা খুনসুটি
খুব ভালোবাসে।।
কথা আছে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।
এই জীবন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন, বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক
আমি কিছুই ছাড়বো না, এই রোদ ও বৃষ্টি
আমাকে দাও ক্ষুধার অন্ন
শুধু যা নয় নিছক অন্ন
আমার চাই সব লাবণ্য
নইলে গোটা দুনিয়া খাবো!
আমাকে কেউ গ্রামে গঞ্জে ভিখারী করে
পালিয়ে যাবে?
আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো কলে
কামারশালায়?
আমি কিছুই ছাড়বো না আর, এখন আমার
অন্য খেলা
পদ্মপাতায় ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে
গোটা জীবন
মানুষ সেজে আসা হলো,
মানুষ হয়েই ফিরে যাবো
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন,বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক!
ইচ্ছে হয় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে এক জীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?
রূপের মধ্যে মানুষ আছে, এই জেনে কি নারীর কাছে
রঙের ধাঁধা খুঁজতে খুঁজতে টনটনায় চক্ষু-স্নায়ু
কপালে দুই ভুরুর সন্ধি, তার ভিতরে ইচ্ছে বন্দী
আমার আয়ু, আমার ফুল ছেঁড়ার নেশা
নদীর জল সাগরে যায়, সাগর জল আকাশে মেশে
আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার
মুঠোয় ফেরা!
শিল্পী ফিরে চলেছেন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী ফিরে চলেছেন, এ কেমন চলে যাওয়া তার?
এমন নদীর ধার ঘেঁষে চলা,
যেখানে অজস্র কাঁটাঝোপ
এবং অদূরে রুক্ষ বালিয়াড়ি,
ওদিকে তো আর পথ নেই
এর নাম ফিরে যাওয়া? এ তো নয় শখের ভ্রশণ
রমণীর আলিঙ্গন ছেড়ে কেন সহসা লাফিয়ে ওঠা-
কপালে কোমল হাত, টেবিলে অনেক সিক্ত টিঠি
কত অসমাপ্ত কাজ, কত হাতছানি
তবু যেন মনে পড়ে মভুল ভাঙাবার বেলা এই মাত্র
পার হয়ে গেল!
বুকে এত ব্যাকুলতা, ওষ্ঠে এত মায়া
তবু ফিরে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে
এর নাম ফিরে যাওয়া? এতো নয় শখের ভ্রমণ
ওদিক তো আর পথ নেই
অচেনা অঞ্চলে কেউ ফেরে? যাওয়া যায়। ফেরে?
এর চেয়ে জলে নামা সহজ ছিল না?
সকলেই বলে দেবে, শিল্পী, আপনি ভুল করেছেন
অতৃপ্ত, দুঃখিত এক বৃহত্তম ভুল।।
মায়া – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মায়া যেন সশরীর, চুপে-চুপে
মশারির প্রান্তে এসে জ্বালছে দেশলাই
ভেতরে ঘুমন্ত আমি-
বাতাস ও নিস্তব্ধতা এখন দর্শক
রাত্রি এত স্নিগ্ধ, এত পরিপূর্ণ,
যেন নদী নয়, স্বপ্ন নয়।
স্বয়ং মায়ার হাত আমাকে আদর করে ঘুম পাড়ালো!
আবার কৌতুকে মেতে মশারিতে
জ্বালাবে আগুন
সমস্ত জানলা বন্ধ, দরোজায় চাবি
আহা কী মধুর খেলা,
সশস্ত্র সুন্দর!
আমাকে জাগাও তুমি,
আমাকে দেখতে দিও শুধু ।।
ভালোবাসার পাশেই – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
প্রেমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়
ছাদের ঘরে
কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক
হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!
কবিতাকে আমি ভুলে থাকি যদি
অমনি সে রেগে হঠাৎ আমায়
ডবল ডেকার বাসের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়
আমার অসুখে শিয়রের কাছে জেগে বসে থাকে
আমার অসুখ কেড়ে নেওয়া তার প্রিয় খুনসুটি
আমি তাকে যদি
আয়নার মতো
ভেঙ্গে দিতে যাই
সে দেখায় তার নগ্ন শরীর
সে শরীর ছুঁয়ে শান্তি হয় না, বুক জ্বলে যায়
বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়।
নিজের আড়ালে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখে না
সে খোঁজে ভ্রমর বিংবা
দিগন্তের মেঘের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
কতকাল দেখে না আকাশ
কতকাল নদী বা ঝরনায় আর
দেখে না নিজের মুখ
আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
রমনীর কাছে গিয়ে
বারবার হয়েছে কাঙাল
যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ
বহু বছরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়
অসম্ভব অভিমান খুন করে পরমা নারীকে
অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে
ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে।।
নারী ও শিল্প – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঘুমন্ত নারীকে জাগাবার আগে আমি তাকে দেখি
উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
ঠোঁটে স্বপ্ন বিংবা অসমাপ্ত কথা
এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, বিংবা
দর্পণের ঘরে বস
চিবুকের ওপরে এসে পড়েছে চুলের কালো ফিতে
সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না, কেননা আবহমান কাল
থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা কয়েছে
আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে
নিছক ভদ্রতাবশে নিভিয়ে দিই আলো
তারপর শুরু হয় শিল্পকে ভাঙার এক বিপুল উৎসব
আমি তার ওষ্ঠ ও উরুতে মুখ গুঁজে
জানাই সেই খবর
কালস্রোত সাঁতরে যা কোথাও যায় না।
নারী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্গ ঈ-কারের মত তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছো!
এমনকি অদৃশ্য তুমি বহু চোখে
কত লোকে নামই শোনেনি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো-
তারা চেনে প্রেমিকা বা সহোদরা
জননী বা জায়া
দুধের দোকানে মেয়ে, কিংবা যারা নাচে গায়
রান্না ঘরে ঘামে
শিশু কোলে চৌরাস্তায় বাড়ায় কঙ্কাল হাত
ফ্রক কিংবা শাড়ী পরে দুঃখের ইস্কুলে যায়
মিস্তিরির পাশে থেকে সিমেন্ট মেশায় কান্না
কৌটো হাতে পরমার্থ চাঁদা তোলে
কৃষকের পান্তা ভাত পৌছে দেয় সূর্য ক্রুদ্ধ হলে
শিয়রের কছে রেখে উপন্যাস দুপুরে ঘুমোয়
এরা সব ঠিকঠাক আছে
এদের সবাই চেনে শয়নে, শরীরে
দুঃখ বা সুখের দিনে অচির সঙ্গিনী!
কিন’ নারী? সে কোথায়?
চল্লিশ শতাব্দী ধরে অবক্ষয়ী কবি দল
যাকে নিয়ে এমন মেতেছে?
সে কোথায়? সে কোথায়?
দীর্ঘ ঈ-কারের মত চুল মেলে
সে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে?
এই ভিড়ে কেমন গোপন থাকো তুমি
যেমন জলের মধ্যে মিশে থাকে
জল-রং আলো…
কথা ছিল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সামনে দিগন্ত কিংবা অনন্ত থাকার কথা ছিল
অথচ কিছুটা গিয়ে
দেখি কানা গলি
ঘরের ভিতরে কিচু গোপন এবং প্রিয়
স্মৃতিচিহ্ন থেকে যাওয়া
উচিত ছিল না?
নেই, এই দুৎখ আমি কার কাছে বলি!
সমস্ত নারীর মধ্যে একজনই নারীকে খুঁজেছি
এ-রকমই কথা ছিল
স্নিগ্ধ ঊষাকালে
প্রবল স্রোতের মতো প্রতিদিন ছুটে চলে যায়
জন্ম থেকে বারবার খসে পড়ে আলো
রাত্রির জানলার পাশে আবার কখনো হয়তো
ফিরে আসে
ফুটে ওঠে ছোট্ট কুন্দ কলি।
তবু ঘোর ভেঙে যায় কোনো- কোনো দিন
চেয়ে দেখি, সত্য নয়
শুধুই তুলনা!
নেই, এই দুঃখ আমি কার কাছে বলি!
একটি শীতের দৃশ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মায়ামমতার মতো এখন শীতের রোদ
মাঠে শুয়ে আছে
আর কেউ নেই
ওরা সব ফিরে গেছে ঘরে
দু’একটা নিবারকণা খুঁটে খায় শালিকের ঝাঁক
ওপরে টহল দেয় গাংচিল, যেন প্রকৃতির কোতোয়াল।
গোরুর গাড়িটি বড় তৃপ্ত, টাপুটুপু ভরে এছ ধানে
অন্যমনা ডাহুকীর মতো শ্লথ গতি
অদূরে শহর আর ক্রোশ দুই পথ
সেখানে সবাই খুব প্রতীক্ষায় আছে
দালাল, পাইকার, ফড়ে, মিল, পার্র্টি, নেকড়ে ও পুলিস
হলূদ শস্যের স্তূপে পা ডুবিয়ে
ওরা মল্লযুদ্ধে মেতে যাবে
শোনা যাবে ঐক্যতান, ছিঁড়ে খাবো চুষে খাবো
ঐ লোকটিকে আমি তোদের আগে ছিঁড়ে খাবো।
সিমেন্টের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছে সেই লোকটা
বিড়ির বদলে সিগারেট
আজ সে শৌখিন বড়, চুলে তেল, হোটেলের ভাত খেয়ে
কিনেছিল এক খিলি পান
খেটেছে রোদ্দুরে জলে দীর্ঘদিন, পিতৃস্নেহ
দিয়েছিল মাঠে
গোরুর গাড়ির দিকে চোখ যায়, বড় শান্ত এই
চেয়ে থাকা
সোনালী ঘাসের বীজ আজ যেন নারীর চেয়েও গরবিনী
সহস্র চোখের সামনে গায়ে নিচ্ছে
রোদের আদর
এখনই যে লুট হবে কিছুই জানে না
পালক পিতাটি সেই সঙ্গে-সঙ্গে যাবে
যারা অগ্নিমান্দ্যে ভোগে তারা ঐ লোকটির
রক্ত মাংস খাবে।
আচর্য শঙ্কর, আমি করজোড়ে অনুরোধ করি
আকস্মাৎ এই দৃশ্যে আপনি এসে যেন না বলেন
এ তো সবই মায়া!
একটি কথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।
ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাসা
বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা
বালির নীচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইলো, থেকেই যাবে।
আমি নয় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পথে পড়ে আছে এত কৃষ্ণচুড়া ফুল
দু’পায়ে মাড়িয়ে যাই, এলোমেলো হাওয়া
বড় প্রীতি-স্পর্শ দেয়, যেন নারী, সামনে বকুল
যার ঘ্রাণে মনে পড়ে করতল, চোখের মাধুরী
তারপরই হাসি পায়, মনে হয় আমি নয়, এই ভোরে
এত সুন্দরের কেন্দ্র চিরে
গল্পের বর্ণনা হয়ে হেঁটে যায় যে মানুষ
সে কি আমি?
ক্ষ্যাপাটের মত আমি মুখ মচকে হাসি।
ক্যাবিনের পর্দা উড়লে দেখা যায় উরুর কিঞ্চিৎ
একটি বাহুর ডৌল, টেবিলে রয়েছে ঝুঁকে মুখ
ও পাশে কে? ইতিহাস চূর্ণ করা নারীর সম্মুখে
রুক্ষচুল পুরুষটি এমন নির্বাক কেন? শুধু সিগারেট
নেড়েচেড়ে, এর নাম অভিমান? পাঁচটি চম্পক
এত কাছে, তবু ও নেয় না কেন, কেন ওর ওষ্ঠে
দেয় না গরম আদর?
শুধু চোখে চোখ- এটি অলৌকিক সেতু, একি
অসম্ভব চিন্ময়তা
চায়ের দোকানে ঐ পুরুষ নারূ-মূত্যি ব্যাথা দেয়
বুকের বড় ব্যাথা দেয়
ওরা এই পৃথিবীর কেউ নয় ইদানীং বেড়াতে এসেছে।
মধ্যরাত্রি ভেঙে-ভেঙে কে কোথায় চলে যায়, যেন উপবনে বসন্ত উঃসব হলো শেষ
বিদায় শব্দটি যাকে বিহ্বল করেছে
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে সে এখন দ্রুত উঠে আসে
চাঁদের শরীর ছুঁতে
অথবা স্বর্গের পথ এই দিকে হঠাৎ ভেবেছে
দরজা খুলো না তুমি, দূর থেকে রুক্ষ বাক্য বলে দাও
ও এখন দুঃখে- নোংরা, দু’হাতে তীব্রতা
এবং কপালে তৃষ্ণা, পর্দাহীন জানলার দিকে
দুই চোখ
মাতালের অসি’রতা মাধুর্যকে ওষ্ঠে নিতে চায়-
অথচ জানে না
গোলূলির কাছে তার নির্বাসন হয়ে গেছে কবে!
দরজা খুলো না তুমি, দুর থেকে রুক্ষ বাক্য বলে দাও
ও তোমার জানু আঁকড়ে আহত পশুর মতো ছটফটাবে
অতৃপ্তির সহোদর, সশরীর নিষিদ্ধ আগুন
ক্ষমা করো, আমি নই, ক্ষমা করো, দুঃস্বপ্ন, বিষাদ……
আছে ও নেই – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাগলটি
পৃথিবীর সমস্ত পাগলের রাজা হয়ে
সে উলঙ্গ, কেননা উম্মাদ উলঙ্গ হতে পারে, তাতে
প্রকৃতির তালভঙ্গ হয় না কখনো
পাশেই গম্ভীর ট্রেন, ব্যস্ত মানুষের হুড়োহুড়ি
সকলেই কোথাও না কোথাও পৌছুতে চায়
তার মধ্যে এই মূর্তিমান ব্যতিক্রম, ইদানীং
অযাত্রী, উদাসীন-
মাঝারি বয়েস, লম্বা, জটপাকানো মাথা
তার নাম নেই, কে জানে আমিত্ব আছে কিনা
অথচ শরীর আছে
সুতোহীন দেহখানি দেহ সচেতন করে দেয়
পেটা বুক, খাঁজ-কাটা কোমর, আজানুলম্বিত বাহু
এবং দীর্ঘ পুরুষাঙ্গ
চুলের জঙ্গলে ঘেরা
পুরুষশ্রেষ্টের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিড়ে, যেন সদর্পে
সন্ন্যাসী হলেও কোনো মানে থাকতো, কেউ হয়তো প্রণাম জানাতো
কিন্তু এই শারীরিক প্রদর্শনী এত অপ্রাসঙ্গিক
টিকিটবাবুও তাকে বধা দেয় না
রেলরক্ষীরা মুখ ফিরিয়ে থাকে
ফিলমের পোস্টারের নারী-পুরুষদের সরে যাবার উপায় নেই
অপর নারী-পুরুষরা তাকে দেখেও দেখে না
তারা পাশ দিয়ে যেতে-যেতে একটু নিমেষহারা হয়েই
আবার দূরে চলে যায়
শুধু মায়ের হাত ধরা শিশুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে
একটি আপেল গড়ি েযায় লাইনের দিকে-
ঠিক সেই সময় বস্তাবন্দী চিঠির স’পের পাশ দিয়ে
এসে দাঁড়ায় দুটি হিজড়ে
নারীর বেশে ওরা নারী নয়, এবং সবাই জানে
ওদের বিস্ময়বোধ থাকে না
তবু হঠাৎ ওরা থমকে দাঁড়ায়; পরস্পরের দিকে
তাকায় অদ্ভুত বিহ্বল চোখে
যেন ওদের পা মাটিতে গেঁথে গেল
সার্চ লাইটের মতন চোখ ফেরালো পাগলটির শরীরে
সেই অপ্রয়োজনীয় সুঠাম সুন্দর শরীর,
নির্বিকার পুরুষাঙ্গ
যেন ওদের শপাং-শপাং করে চাবুক মারে
সূর্য থেকে গল-গল করে ঝরে পড়ে কালি
এই আছে ও নেই’-র যুক্তিহীন বৈষম্যে প্রকৃতি
দুর্দান্ত নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে
সেই দুই হিজড়ে অসম্ভব তীব্র চিৎকার করে ওঠে-
ধর্মীয় সঙ্গীতের মতন
ওরা কাঁদে,
দু’হাতে মুখ ঢাকে
বসে পড়ে মাটিতে
এবং টুকরো-টুকরো হয়ে মিশে যায়
নশ্বর ধুলোয়
অল্প দূরে, সিগারেট হাতে আমি এই দৃশ্য দেখি।।
সখী আমার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সখী, আমার তৃষ্ণা বড় বেশি, আমায় ভুল বুঝবে?
শরীর ছেনে আশ মেটে না, চক্ষু ছুঁয়ে আশ মেটে না
তোমার বুকে ওষ্ঠ রেখেও বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়
যেন আমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
দিঘির পাড়ে বকের সাথে দেখা হলো না!
সখী, আমার পায়ের তলায় সর্ষে, আমি
বাধ্য হয়েই ভ্রমণকারী
আমায় কেউ দ্বার খোলে না, আমার দিকে চোখ তোলে না
হাতের তালু জ্বালা ধরায়, শপথগুলি ভুল করেছি
ভুল করেছি
মুহুর্মুহু স্বপ্ন ভাঙে, স্বপ্নে আমার ফিরে যাওয়ার
কথা ছিল, স্বপ্নে আমার স্নান হলো না।
সখী, আমার চক্ষুদুটি বর্ণকানা, দিনের আলোয়
জ্যোৎস্না ধাঁধা
ভালোবাসায় রক্ত দেখি, রক্ত নেশায় ভ্রমর দেখি
সুখের মধ্যে নদীর চড়া, শুকনো বালি হা হা তৃষ্ণা
হা হা তৃষ্ণা
কীর্তি ভেবে ঝড়ের মুষ্টি ধরতে গেলাম, যেন আমার
ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেন আমার
স্বরূপ দেখা শেষ হলো না।
মনে মনে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যে আমায় চোখ রাঙিয়ে এইমাত্র চলে গেল গট্গটিয়ে
সে আমায় দেয়ে গেল একটুকরো সুখ
শরীরে নতুন করে রক্ত চলাচল টের পাই
ইন্দ্রিয় সুতীক্ষ্ম হয়ে ওঠে
মৃদু হেসে মনে মনে
আমি তার নাম কেটে দিই।
সে আর কোথাও নেই,
হিম অন্ধকার এক গভীর বরফঘরে
নির্বাসিত, আহা সে জানে না!
সে তার জুতোর শব্দে মুগ্ধ ছিল
প্যান্টের পকেটে হাত
স্মৃতিহার বিভ্রান্ত মানুষ।
দাবা খেলুড়ের মতো আমি তাকে
এক ঘরে থেকে তুলে
অন্য ঘরে বসিয়ে চুপ করে চেয়ে থাবি
উপভোগ করি তার ছটফটানি!
জালের ফুটোর মধ্যে নাক দিয়ে
যেমন বিষণ্ন থাকে জেব্রা
শুকনো নদীর পাশে যে-রকম দুঃখী ঘাটোয়াল
আমার হঠাৎ খুব মায়া হয়
আমি তার রমণীকে নরম সান্ত্বনাবাক্য বলি
দু‘হাত ছড়িয়ে ফের
তছনছ করে দিই খেলা।।
বয়েস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমার নাকি বয়েস বাড়ছে? হাসতে হাসতে এই কথাটা
স্নানের আগে বথরুমে যে কবার বললুম!
এমন ঘোর একলা জায়গায় দুপাক নাচলেও
ক্ষতি নেই তো-
ব্যায়াম করে রোগা হবো, সরু ঘেরের প্যান্ট পরবো ?
হাসতে হাসতে দম পেটে যায়, বিকেলবেলায়
নীরার কাছে
বলি, আমার বয়েস বাড়ছে, শুনছো তো? ছাপা হয়েছে!
সত্যি সত্যি বুকের লোম, জুলপি, দাড়ি কাঁচায় পাকা-
এই যে চেয়ে দ্যাখো
দেখে সবাই বলবে না কি ছেলেটা কই, ও তো লোকটা!
এ সব খুব শক্ত ম্যাজিক, ছেলে কীভাবে লোক হয়ে যায়
লোকেরা ফের বুড়ো হবেই এবং মরবে,
আমিও মরবো
আরও খনিকটা ভালোবেসে, আরও কয়েকটা পদ্য লিলে
আমিও ঠিক মরে যাবো-
কী, তাই না?
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলুম, এ জায়গাটা এত অচেনা
আমার ছিল বিশাল রাজ্য, তার বইরেও এত অসীম
শরীরময় গান-বাজনা, পলক ফেলতেও মায়া জাগে
এই ভ্রমণটা বেশ লাগলো, কম কিছু তো দেখা হলো না
অন্ধকারও মধুর লাগে, নীরা, তোমার হাতটা দাও তো
সুগন্ধ নিই।
নীরা, শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে।
তুমি যেখানেই যাও – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তুমি যেখানেই যাও
আমি সঙ্গে আছি
মন্দিরের পাশে তুমি শোনো নি নিঃশ্বাস?
লঘু মরালীর মতো হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্না রাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হয়ে তুমি য়েলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনো নি?
তোমার গালের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে
চুর্ণ অলক?
তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনি
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি
তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না
শুকনো ফুলের মালা যে-রকম বলে দেয়
সে এসেছে
চড়ুই পাখিরা জানে
আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি
এলচের দানা জানে
কার ঠোঁট গন্ধময় হবে-
তুমি ব্যস্ত, তুমি একা, তুমি অন্তরাল ভালোবাসো
সন্ন্যাসীর মতো হাহাকার করে উঠি
দেখা দাও, দেখা দাও,
পরমুহূর্তেই ফের চোখ মুছি
হেঁসে বলি,
তুমি যেখানেই যাও, আমি সঙ্গে আছি!
জাগরণ হেমবর্ণ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও
আরও কাছে যাও
ও কেন হিংসার মতো শুয়ে আছে যাখন পৃথিবী খুব
শৈশবের মতো প্রিয় হলো
জল কনা- মেশা হওয়া এখন এ আশ্বিনের প্রথম সোপানে
বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়
আরও কাছে যাও
জাগরণে হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।
মধু-বিহ্বলেরা কাল রাত্রিকে খেলার মাঠ করেছিল
ঘাসের শিশিরে তার খণ্ডচিহ্ন
ট্রেনের শব্দের মতো দিন এলে সব মুছে যায়
নিথর আলো মধ্যে
চমশা-পরা গয়লানী হাই তোলে দুধের গুমটিতে
নিথর আলোর মধ্যে
কাক শালিকের চক্ষু শান
রোদ্দুরের বেলা বাড়ে, এত স্বচ্ছ
নিজেকে দেখে না
আর খেলা নেই
ও কেন স্বপ্নের মধ্যে রয়ে যায়
শরীরে বৃষ্টির মতো মোহ
আরও কাছে যাও
জাগরণ হেমবর্ণ, তুমি ওকে সন্ধ্যায় জাগাও।।
চেনার মুহূর্ত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বহু অর্চনা করেছি তোমায়, এখন ইচ্ছে
টেনে চোখ মারি
হে বীণাবাদিনী, তুমিও তো নারী, ক্ষমা করো এই
বাক-ব্যবহার
তুমি ছাড়া আর এমন কে আছে, যার কাছে আমি
দাস্য মেনেছি-
এবার আমাকে প্রশ্রয় দাও, একবার আমি
ছিনা টান করি।
একবার এই পাংশুবেলায় তুমি হয়ে ওঠো
শরীরী প্রতিমা
অনেক দেখেছি দুনিয়া বাহার, এবার ফুঁদিয়ে
নেভাই গরিমা
হলুদকে বলা রক্তিম হতে-ভাষাভ্রান্তির
এই উপহাস
মানুষকে বড় বিমূঢ় করেছে, এবার অস্ত্র
দুঃখ-দহন।
জানি না কোথায় পড়েছিল বীজ, পৃথিবীতে এত
ভুল অরণ্য
দুঃখ সুখের খেলায় দেখেছি বারবার আসে
প্রগাঢ় তামস
তোমার রূপের মায়াবী বিভায় একবার জ্বালো
ক্ষণ-বিদ্যুৎ
চোখ যেন আর চিনতে ভোলে না, তুমি জানো আমি
কত অসহায়।
কবির দুঃখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল
গোপনে
শব্দ তার প্রতিবিম্ব আমাকে দেখাবে বলেছিল।
শব্দ ভেঙে গেল যেন শৃঙ্খলের মতো শব্দ হয়
পাহাড়ের চূড়া থেকে খসে পড়া রূপালি পাতার মতো
সন্ধ্যায় সূর্যকে দীপ্ত দেখে
লক্ষ বৎসরের পর এক মুহূর্তের জন্য দুর্লভ স্বরাজ
বুকের ভিতর যেন তোমার মুখের মতো প্রতিবিম্ব শিল্পে ঝলসে ওঠে
মনে হয়
সমস্ত শিল্পের সার তোমার ও মুখের বর্ণনা
সমস্ত শিল্পের সার তোমারও মুখের বর্ণনা
কালহীন, বর্ণহীন
প্রতিশব্দহীন
আমি সূর্যকরোজ্জল হ্রদের কিনার তবু ভালেরির মতো
পাইনি প্রার্থিত শব্দ, উদ্ভাসিত প্রতিবিম্ব, যদিও আমাকে
প্রেম তার প্রতিমূর্তি গোপনে দেখাবে বলেছিল।।
আমিও ছিলাম – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পাঁচজনে বলে পাঁচ কথা, আমি নিজেকে এখনো চিনি না
চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে
দশ দিকে চেয়ে আলোর আকাশে আয়নায় মুখ দেখা
আমিও ছিলাম, আমিও ছিলম, এই সুখে নিশ্বাস
জনি না কোথায় ভূল হয়ে যায়, ছায়া পড়ে ঘোর বনে
ঝড়ে বৃষ্টিতে পায়ে পায়ে হেঁটে যাকে মনে করি বন্ধু
সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, চোখে অচেনা মতন ভ্রূকুটি
নেশায় রক্ত উম্মাদ হয়, তছনছ করি নারীকে
অস্তিত্বের সীমানা ছাড়িয়ে জেগে ওঠে সঙহার
আঁধার সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে চোখ জ্বালা করে ওঠে।
চেয়েছিলাম তো সকালবেলার শুদ্ধ মানুষ হতে
বারবার সব ভুল হয়ে যায় এত বিপরীত স্রোত
বুকের মধ্যে পুবল নিদাঘ, পশ্চিমে হেলে মাথা
আমিও ছিলাম, আমিও ছিলাম, কান্নার মতো শোনায়!
অপেক্ষা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সকালবেলা এয়ারপোর্টে গেয়েছিলাম একজন বৃদ্ধ আন্তর্জাতিক
ফরাসীর সঙ্গে দেখা করার জন্য, যিনি নিজের শৈশবকে ঘৃণা
করেন।
তিনি তখনো আসেননি, আমি একা বসে রইলাম ভি আই পি
লাউঞ্জে। ঠান্ড ঘর, দুটি টাটকা ডালিয়া, বর্তমান রাষ্ট্রপতির
বিসদৃশ রকমের বড় ছবি। সিগারেট ধরিয়ে আমি বই খুলি।
যে- কোনো বিমানের শব্দে আমার উৎকর্ণ হয়ে ওঠার দরকার
নেই। বিশেষ অতিথির ঘর চিনতে ভুল হয় না। সিকিউরিটির
লোক একবার এসে আমাকে দেখে যায়। আমি অ্যাশট্রের
বদলে ছাই ফেলি সোফার গদিতে-কারণ, এতে বিছু যায়
আসে না।
সময়ের মুহূর্ত, পল, অনুপল স্তব্ধ হয়ে থকে-এক বন্ধ
বিরাট নির্জন ঘর, আমি একা, আমার পা ছড়ানো -আকাশ
থেকে মহাকাশে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় স্মৃতি, তার মধ্যে একটা
সূর্যমুখী ক্রমশ প্রকাণ্ড থেকে আরও বিশাল, লক্ষ লক্ষ
সমান্তরাল আলো, যুদ্ধ-প্রতিরোধের মিছিলের মতন,
যেন অজস্র মায়াময় চোখ দংশন করে নির্জনতা, ঘুমের
মধ্যে পাশ ফেরার মতন-
একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার জন্য নয়, আমার
জন্য নয়-||
অন্য লোক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যে লেখে, সে আমি নয়
কেন যে আমায় দোষী করো!
আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুব্ধ হয়ে ছিঁড়েছি শৃঙ্খল?
নদীর কিনারে তার ছেলেবেলা কেটেছিল
সে দেখেছে সংসারের গোপন ফাটল
মাংসল জলের মধ্যে তার আয়না খুঁজেছে, ভেঙেছে।
আমি তো ইস্কুলে গেছি, বই পড়ে প্রকাশ্য রাস্তায়
একটা চাবুক পেয়ে হয়ে গেছি শূন্যতায়
ঘোড়সওয়ার।
যে লেখে সে আমি নয়
যে লেখে সে আমি নয়
সে এখন নীরার সংশ্রবে আছে পাহাড়-শিখরে
চৌকো বাব্যের সঙ্গে হাওয়াকেও
হারিয়ে গেয় দুরন্তপনায়
কাঙাল হতেও তার লজ্জা নেই
এবং ধ্বসের জন্য তার এত উম্মত্ততা
দূতাবাস কর্মীকেও খুন করতে ভয় পায় না
সে কখনো আমার মতন বসে থাকে
টেবিলে মুখ গুঁজে?
স্পর্শটুকু নাও – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ছেঁড়া পৃষ্ঠা উড়ে যায়, না-লেখা পৃষ্ঠাও কিছু ওড়ে
হিমাদ্রি-শিখর থেকে ঝুঁকে-জড়া জলাপ্রপাতের সবই আছে
শুধু যেন শব্দরাশি নেই
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ভোর আনে শালিকেরা, কোকিল ঘুমন্ত, আর
জেগে আছে দেবদারু বন
নীলিমার হিম থেকে খসে যায় রূপের কিরীট
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
বেলা গেল, শোনোনি কি ছেলেমানুষীরা কোনো
ভুল করা ডাক?
এপারে মৃত্যুর হাতছাছি আর অন্য পারে
অমরত্ব কঠিন নীরব
‘মনে পড়ে?’ এই ডাক কতকাল, কত শতাব্দীর
জলে ধুয়ে যায় স্মৃতি, কার জল কোন জল
কবেকার উষ্ণ প্রস্রবণ
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ।
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
বুঝি পাহাড়ের পায়ে পড়েছিল নীরব গোধূলি
নারী-কলহাস্য শুনে ভয় পেল ফেরার পাখিরা
পাথরের নিচে জল ঘুমে মগ্ন কয়েকশো বছর
মোষের পিঠের মতো, রাত্রির মেঘের মতো কালো
পাথর গড়িয়ে যায়, লম্বা গাছ শব্দ করে শোয়
একজন ক্ষ্যাপা লোক ঝর্নাটিতে জুতোসুদ্ধু নামে
কেউ কোনো দুঃখ পায় না, চতুর্দিকে এমনই স্বাধীন!
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
এই যে সবুজ দেশ, এরও মধ্যে রয়েছে খয়েরি
রূপের পাতলা আভা, তার নিচে গহন গভীর
অ্যালুমিনিয়াম-রঙা রোদ্দুরের বিপুল তান্ডব
বনের ভিতরে এত হাসিমুখ ক্ষুধার্ত মানুষ
যে-জন্য এখানে আসা, তার কোনো নাম গন্ধ নেই
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না
এখানে ছিল না পথ, আজ থেকে যাত্রা শুরু হলো
একটি সঠিক টিয়া নামটি জানিয়ে উড়ে যায়
বিবর্ণ পাতায় ছোঁয়া ভালোবাসা-রিস্মৃতির খেদ
পা-ছড়িয়ে বসে আছে ছাগল-চরানো বোবা ছেলে
উদাসী ছায়ার মধ্যে ভাঙা কাচ, নরম দেশলাই
এইমাত্র ছুটে এল যে-বাতাস তাতে যেন চিরুনির দাঁত
সুন্দর মেখেছে এত ছাই-ভস্ম, ভালোই লাগে না…
মানস ভ্রমণ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ইচ্ছে তো হয় সারাটা জীবন
এই পৃথিবীকে
এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে যাই দুই
পায়ে হেঁটে হেঁটে
অথবা বিমানে। কিংবা কী নেবে
লোহা শুঁয়ো পোকা?
অথবা সওদাগরের, নৌকো, যার গলুইয়ের
দু‘পাশে দু‘খানি
রঙিন চক্ষু, অথবা তীর্থ যাত্রীদলের, সার্থবাহের
সঙ্গী হবো কি?
চৌকো পাহাড়, গোল অরণ্যে মায়ার আঙুলে
হাতছানি দেয়
লাল সমুদ্র, নীল মরুভূমি, অচেনা দেশের
হলুদ আকাশ
সূর্য ও চাঁদ দিক বদলায় এন গহন
আমায় ডেকেছে
কিছু ছাড়বো না, আমি ঠিক জানি গোটা দুনিয়াটা
আমার মথুরা
জলের লেখায় আমি লিখে যাবো এই গ্রন’টির
তন্নতন্ন
মানস ভ্রমণ।
প্রতীক জীবন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রতীকের মুরুভূমি পায় না কখনো মরূদ্যান
যেমন নরীর নেই আঙুলের ব্যথা কবিতায়
আমার সমুদ্র নেই বিছানা, শিয়রের কাছে
শান্ত মেঘ
কবিতায় আছে।
বিংশ শতাব্দরি ঠিক মাঝামাঝি ভেঙেছিল ঘুম
গ্রাম্য সোঁদা গন্ধ-মাখা ক্ষ্যাপাটে কৈশোর
কেটেছে বাসনা-ক্ষুব্ধ মুখ চোরা দিন, প্রতিদিন
অথচ অক্ষরে, শব্দে, ছন্দ-মিলে তীব্র প্রতিশোধ
না-পাওয়া নারীর রূপে অবগাহনের উম্মত্ততা
প্রতীক জীবন, নেই মরূদ্যান, জ্যোৎস্নার সমুদ্র, নেই
শিয়রের কাছে শান্ত মেঘ-
কবিতায় আছে।
ঝড় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঝড়ের ঝাপটায় উল্টে গেল একটি ঘুঘু পাখি
সে ঝড়কে ডেকেছিল
ঝড়ের ভালোবাসায় জেলেদের গ্রামটিতে আছড়ে পড়লো সমুদ্র
সমুদ্র ঝড়কে ডাকে
পাকের পাথরের মূর্তি অন্ধকারে দু‘হাত তোলে
শুকনো পাতারা জড়ো হয় তার পায়ের কাছে
কানা কাড়ির মতন পথের শিশুরা এদিক-ওদিক দৌড়ে যায়
মাটি কাঁপে, মাটি কাঁপে
মাটি ফিসফিস করে কথা বলে, ঘুমন্ত ভিখারিণীটি শোনে
ফুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অভিভূত কীট
কেউ বাজায় না, তবু বেজে ওঠে বাঁশি
রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝনঝন করে ছিটকে পড়ে মোজাইক মেঝেতে
তিনি ঝড়ের গান গেয়েছিলেন!
একটাই তো কবিতা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটাই তো কবিতা
লিখতে হবে, লিখে যাচ্ছি সারা জীবন ধরে
আকাশে একটা রক্তের দাগ, সে আমার কবিতা নয়
আমার রাগী মুহূর্ত কবিতা থেকে বহুদূরে সরে যায়
একটাই তো কবিতা লিখতে হবে
অথচ শব্দ তাকে দেখায় না সহস্রার পদ্ম
যজ্ঞ চলেছে সাড়স্বরে, কিন্তু যাজ্ঞসেনী অজ্ঞাতবাসে
একটাই কো কবিতা
কখন টলমলে শিশিরের শালুক বনে ঝড় উঠবে তার ঠিক নেই
দরজার পাশে মাঝে মাঝে কে যেন এসে দাঁড়ায় মুখ দেখায় না
ভালোবাসার পাশে শুয়ে থাকে হিংস্র একটা নেকড়ে
নদীর ভেতর থেকে উঠে আসে গরম নিশ্বাস
আকটাই তো কবিতা লিখতে হবে
আগোছাল কাগজপত্রের মধ্য থেকে উকি মারে ব্যর্থতা
অপমান জমতে জমতে পাহাড় হয়, তার ওপর উড়িয়ে দেবার কথা স্বর্গের পতাকা
শজারুর মতন কাঁটা ফুলিয়ে চলঅ-ফেরা করতে হয় মানুলের মধ্যে
রাত্রে সিগারেট ধরিয়ে মনে হয়, এ-এক ভুলমানুষের জীবন
বূল মানুষেরা কবিতা লেখে না, তারা অনেক দূরে, অনেক দূরে
যেন বজ্রকীট উল্টো হয়ে পড়ে আছে, এত অসহায়
নতুন ইতিহাসের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে সম্রাটদের কাঙালপনা
একটাই তো কবিতা, লিখে যাচ্ছি
লিখে যাবো, সারা জীবন ধরে
আবার দেখা হবে, আবার দেখা হবে, আবার দেখা হবে!
ঝড় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঝড়ের ঝাপটায় উল্টে গেল একটি ঘুঘু পাখি
সে ঝড়কে ডেকেছিল
ঝড়ের ভালোবাসায় জেলেদের গ্রামটিতে আছড়ে পড়লো সমুদ্র
সমুদ্র ঝড়কে ডাকে
পাকের পাথরের মূর্তি অন্ধকারে দু‘হাত তোলে
শুকনো পাতারা জড়ো হয় তার পায়ের কাছে
কানা কাড়ির মতন পথের শিশুরা এদিক-ওদিক দৌড়ে যায়
মাটি কাঁপে, মাটি কাঁপে
মাটি ফিসফিস করে কথা বলে, ঘুমন্ত ভিখারিণীটি শোনে
ফুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অভিভূত কীট
কেউ বাজায় না, তবু বেজে ওঠে বাঁশি
রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝনঝন করে ছিটকে পড়ে মোজাইক মেঝেতে
তিনি ঝড়ের গান গেয়েছিলেন!
পাওয়া – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
অন্ধকারে তোমার হাত
ছুঁয়ে
যা পেয়েছি, সেইটুকুই তো পাওয়া
যেন হঠাৎ নদীর প্রান্তে
এসে
এক আঁজলা জল মাথায় ছুঁইয়ে যাওয়া।
চে গুয়েভারার প্রতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!।
শব্দ আমার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
শব্দকে তার বাগানটি দাও, শব্দ একলা বন্দী ঘরে
যেমন ছিল বাগান সেই নদীর ধারে পোড়ো বাড়ির
যেমন ছিল পায়ের তলায় সর্ষে, শিশুর খেলনা গাড়ি!
এই বিকেলের সিংহ-মার্কা খাঁটি আলোয় ইচ্ছা করে
ভালোবাসার গায়ে লাগুক খ্যাপার মতন ঝোড়ো বাতাস-
টুকরো-টাক্রা কগজপত্র, মলিন ঘর, ছেঁড়া আঁধার
অনিশ্চিত চিঠির বাক্সে সাত মাইলের গন্ডি বাঁধা
এসব থেকে বেরিয়ে আসুক একটা হল্কা। সারা আকাশ
দু‘ভাগে চিরে একটি অংশ চোরাবাজোরে যে-খুশি-নিক-
আরেক দিকে বাগান, সব ছেলেবেলার স্বপ্নে ফেরা
শিমূল তুলোর ওড়াওড়ি, দিক-ভোলানো দিঙনাগেরা
শব্দ আমার জীবন, আমার এক জীবনের পরম ক্ষণিক!
রূপনারানের কূলে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রূপনারানের কূলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
পৃথিবীতে নতুন চাঁদ উঠেছিল সেদিন,
অজানা ধাতুর মতন আভা
তার নিচে মধুলোভীদের দুরন্ত হুটোপুটি
নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য সিল্কের ওড়না
পাগল গলার গান দিগন্তের কাছে নিয়ে আসে
নারীদের কারুর পা এই ধুলোমাটির পৃথিবী ছোঁয় না।
যেন আমরা এসেছি দৈব পিকনিকে
নতুন চাঁদের নিচে সেই এক নতুন রাত্রি
সেই পূর্ণকে শূন্য করায় প্রতিযোগিতা, গোপন চুম্বন
আঙুলে-আঙুল ছুঁয়ে ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ
গোল স্তনগুলিতে আগুনের হলকা
কৌতুক-হাস্যে ভাঙে বিশেষ তরঙ্গ, যা আগে কেউ জানেনি!
বাতাসের সুগন্ধ আমাকে অনুসরণ করিয়ে নিয়ে যায়
সকলের থেকে খানিকটা দূরে
নদীর কিনারে বসে, আকস্মাৎ একা হয়ে, মনে পড়ে
এই খেলা ভেঙে যাবে!
অথচ জীবন এরকম সুস্বপ্ন হবার কথা ছিল
অথচ জীবন কেন এই স্বপ্ন থেকে নির্বাসিত?
তাকে ফিরিয়ে আনবার জন্য আমি এক হাত জলে ডুবিয়ে
নদীকে সাক্ষী রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমাকে জাগিও।।
নীরার কাছে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
যেই দরজা খুলে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম
শরীর ভরে ঘূর্ণি খেললো লম্বা একটি হলদে রঙের আনন্দ
না খুলতেও পারতে তুমি, বলতে পারতে এখন বড় অসময়
সেই না-বলার দয়ায় হলো স্বর্ণ দিন, পুষ্পবৃষ্টি
ঝরে পড়লো বাসনায়।
এখন তুমি অসম্ভব দূরে থাকো, দূরত্বকে সুদূর করো
নীরা, তোমার মনে পড়ে না স্বর্গনদীর পারের দৃশ্য?
যুথীর মালা গলায় পরে বাতাস ওড়ে একলা একলা দুপুরবেলা
পথের যত হা-ঘরে আর ঘেয়ো কুকুর তারাই এখন আমার সঙ্গী।
বুকের ওপর রাখবো এই তৃষিত মুখ, উষ্ণ শ্বাস হৃদয় ছোঁবে
এই সাধারণ সাধটুকু কি শৌখিনতা? ক্ষুধার্তের ভাতরুটি নয়?
না পেলে সে অখাদ্য কুখাদ্য খাবে, খেয়ার ঘাটে কপাল কুটবে
মনে পড়ে না মধ্যরাতে দৈত্যসাজে দরজা ভেঙে কে এসেছিল?
ভুলে যাওয়ার ভেতর থেকে যেন একটি অতসী রং হল্কা এলো
যেই দরজা খুললে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম।
ধলভূমগড়ে আবার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ধলভূমগড়ে আবার ফিরে গেলাম, যেন এক সৃষ্টিছাড়া
লোভে। ওরা আর কেউ নেই। তরুণ শালবৃক্ষটি, যাঁর
মূলে হিসি করেছিলাম, তিনি এখন পরিবার-প্রধান
হয়েছেন। তাঁর চামড়ায় আর তকতকে সবুজ আঁচ দেখা
যায় না। কাঁটা গাছের ঝাড়ে ঐ থোকা শাদা
ফুলগুলোর নাম কী, জানা হলো না এবারও, ফুলমণি নামে
যে মেয়েটি আমার ওষ্ঠ কামড়ে রক্তদর্শন করেছিল, সে
ডুবে মরেছে দূরের সুবর্ণরেখারয়। সেই নদীর শিয়রে এই
শেষ বিকেলে সূর্যের ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে এখন। পাঁচটি
বিশাল বর্শা বিধে আছে আকাশের উরুতে, যেন এই
মুহূর্তে এক দুর্ধর্ষ খেলা সাঙ্গ হলো। মহুয়ার দোকানটির
কোমরে ঐ সিমেন্টের বেদি না-থাকা ছিল ভালো।
ঐখানে এক উম্মাদিনী নর্তকী দেখিয়েছিল তার তেজী
স্তনের কাঁপন, তার নিতম্বের গোঠে ঝামড়ে উঠেছিল
অন্ধকার। শালিকের মতন সে চলে যাবার পরও শব্দটা
রেখে গেছে। মাতালের অট্টহাসি থামিয়ে দেয় ট্রেনের হুইস্্ল।
জঙ্গলের মধ্যে তিনশো পা স্তব্ধভাবে হেঁটে এক
শুকনো খাঁড়ির পাশে আমরা তিন বন্ধু হাঁটু গেড়ে বসি।
পুরোনো সৈনিকদের ফিরে আসার কথা ছিল, সর্বাঙ্গ
ক্ষতবিক্ষত, তবু আমরা এসেছি। চিনতে পারো?
দেখা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-ভালো আছো?
-দেখো মেঘ, বৃষ্টি আসবে?
-ভালো আছো?
-দেখো ঈশান কোণের কালো, শুনতে পাচ্ছো ঝড়?
-ভালো আছো?
-এই মাত্র চমকে উঠলো ধবধবে বিদ্যুৎ।
-ভালো আছো?
-তুমি প্রকৃতিকে দেখো
-তুমি প্রকৃতিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছো
-আমি তো অণূর অনু, সামান্যের চেয়েও সামান্য
-তুমিই তো জ্বালো অগ্নি, তোলো ঝড়,রক্তে এত উম্মাদনা
-দেখো সত্যিকার বৃষ্টি, দেখো সত্যিকার ঝড়
-তোমাকে দেখাই আজও শেষ হয়নি, তুমি ভালো আছো?
একটি স্তব্ধতা চেয়েছি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল আর এর এক নৈঃশব্দকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না।
জীবন রইলো পড়ে বৃষ্টিতে রোদ্দুরে ভেজা ভূমি
তার কিছু দূরে নদী-
জল নিতে এসে কোনো সলাজ কুমারী
দেখে এক গলা-মোচড়ানো মারা হাঁস।
চোখের বিস্ময় থেকে আঙুলের প্রতিটি ডগায় তার দুঃখ
সে সসয় অকস্মাৎ ডঙ্কা বাজিয়ে জাগে জ্যোৎস্নার উৎসব
কেন, তার কোনো মানে নেই
যেমন বৃষ্টির দিনে অরণ্য শখরে ওঠে
সুপুরুষ আকাশের সপ্তরং ভুরু
আর তার খুব কাছে মধুলোভী আচমকা নিশ্বাসে পায়
বাঘের দুর্গন্ধ!
একটি স্তব্ধতা চেয়েছিল
আর এক নৈঃশব্দ্যকে ছুঁতে
তারা বিপরীত দিকে চলে গেল,
এ জীবনে দেখাই হলো না!
এই দৃশ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
নীল ডুরে শাড়ী, স্বপ্নে পিঠের ওপরে চুল খোলা
বাতাসে অসংখ্য প্রজাপতি কিংবা সবই অভ্রফুল?
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
চোখ দুটি বিখ্যাত সুদূর, পায়ের আঙুলে লাল আভা।
ডান হতে, তর্জনিতে সামান্য কালির দাগ
একটু আগেই লিখছিলে
বাতাসে সুগন্ধ, কোথা যেন শুরু হলো সন্ধ্যারতি
অন্যদেশ থেকে আসে রাত্রি, আজ কিছু দেরি হবে
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
শিল্পের শিরায় আসে উত্তেজনা, শিল্পের দু’চোখে
পোড়ে বাজি
মোহময় মিথ্যেগুলি চঞ্চল দৃষ্টির মতো, জোনাকির মতো উড়ে যায়
কোনোদিন দুঃখ ছিল, সেই কথা মনেও পড়ে না
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো
সময় থামে না জানি, একদিন তুমি আমি সময়ে জড়াবো
সময় থামে না, একদিন মৃত্যু এসে নিয়ে যাবে
দিগন্ত পেরিয়ে-
নতুন মানুষ এসে গড়ে দেবে নতুন সমাজ
নতুন বাতাস এসে মুছে দেবে পুরোনো নি:শ্বাস,
তবু আজ
হাঁটুর ওপরে থুতনি,তুমি বসে আছো
এই বসে থাকা, এই পেঠের ওপরে খোলা চুল,
আঙুলে কালির দাগ
এই দৃশ্য চিরকাল, এর সঙ্গে অমরতা সখ্য করে নেবে
হাঁটুর ওপরে থুতনি, তুমি বসে আছো….
এই জীবন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ফ্রয়েড ও মার্ক্স নামে দুই দাড়িওয়ালা
বলে গেল, মানুষেরও রয়েছে সীমানা
এঁচোড়ে পাকার মত এর পর অনেকেই চড়িয়েছে গলা
নৃমুন্ড শিকারী দেয় মনোলোকে হানা।
সকলেই সব জানে, এত জ্ঞানপাপী
বলেছে মুক্তর রং শাদা নয় খাকি
তবু যারা সিংহাসন নেয় তারা কথার খেলাপি
আবং আমার ভাই, মা-বোন নিখাকী।
ছিঁড়েছে সম্রাজ্য ঢের, নতুন বসতি
পুরোনো হবার আগে দু‘বার উল্টায়
দিকে দিকে গণভোটে রটে যায় বেশ্যারাও সতী
রং পলেস্তারা পড়ে দেয়ালের চলটায়।
এরকম চলে আসে, তবু নিরালায়
ছোট এক কবি বলে যাবে সিধে কথা
সূর্যাস্তের অগ্নিপ্রভা লেগে আছে আকাশের গায়
জীবনই জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা।
আমাকে জড়িয়ে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
হে মৃত্যুর মায়াময় দেশ, হে তৃতীয় যামের অদৃশ্য আলো
তোমাদের অসম্পূর্ণতা দেখে, স্মৃতির কুয়াশা দেখে আমার মন কেমন করে
সারা আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পরম কারুণিক নিষাদ
তার চোখ মেটে সিঁদুরের মতো লাল, আমি জানি তার দুঃখ
হে কুমারীর বিশ্বাসহন্তা, হে শহরতলীর ট্রেনের প্রতারক
তোমাদের টুকিটাকি সার্থকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরোনো মাছের আঁশ
হে উত্তরের জানালার ঝিল্লি, হে মধ্য সাগরের অবিযাত্রী মেঘদল
হে যুদ্ধের ভাষ্যকার, হে বিবাগী, হে মধ্যরয়সের স্বপ্ন, হে জন্ম
এত অসময় নিয়ে, এমন তৃষ্ণার্ত হাসি, এমন করুণা নিয়ে
কেন আমাকে জড়িয়ে রইলে,
কেন আমাকে……………..
নীরা তুমি কালের মন্দিরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
খুঁজে পাবো?
অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায়
মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত
দিতে পারি, অনেক সহজ
কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে
যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে
ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর
জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর
তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা
জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ
নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়!
সোনার মুকুট থেকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটুখানি ভুল পথ, অনায়াসে ফিরে যাওয়া যেত
আকাশে বিদ্যুৎদীপ্ত, বুক কাঁপানো হাতছানি
এই কামরাঙা গাছ, নীল-রঙা ফুল, সবই ভুল
হে কিশোর, তবু তা-ই হলো এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি……
কিছুটা জয়ের নেশা, কিছুটা ভয়ের জন্য দ্রুত ছদ্মবেশ
মৃত চিঠি পড়ে থাকে কালভার্টে নর্দমার জলে
স্বপ্নে কত এক ছিলে, স্বপ্ন ভেঙে মূর্খের মিছিলে
হে কিশোর, সেই অসময় নিয়ে খেলা হলো প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি………
নদীর নরীরা সব ফিরে গেছে, পড়ে আছে নদী
অথবা নারীরা আছে, নদী খুন হয়ে গেছে কবে
যা-কিচু চোখের সামনে, বাদবাকি আঁধার বিস্মৃতি
প্রত্যক্ষের সিংহদ্বার, হে যৌবন হলো এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি……
যে-দুঃখ বোঝে না কেউ তার অশ্রু মরকতমণি
শেষ বিকেলের মৃদু-আলো-মাখা-ঘাসে পড়ে আছে
নির্বাসন ছিল বড় মধুময়, মন গড়া দ্বীপে
প্রেম নয়, হে যৌবন, প্রতিচ্ছবি হলে এত প্রিয়?
সোনার মুকুট থেকে ঝুরঝুরিয়ে খসে পড়লো বালি……
মিথ্যে নয় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কবিতার সার কথা সত্য, অথচ কবিরা সব
মিথ্যুকের একশেষ নয়?
নীরার গলায় আমি কতবার দুলিয়েছি উপমার মণিহার
ভোরবেলা
নীরার দু’হাতে আমি তুলে দিই
শিশির মাখানো সাদা ফুল
ফলগুলি যাদু-সরঞ্জাম যেন
হঠাৎ অদৃশ্য হতে জানে
কতকাল ফুল ছুঁইনি, আঙুল পোড়ায় সিগারেট!
বিশুদ্ধ পোষাক-পরা আমি এক ফুলবাবু
সন্ধেবেলা ফুরফুর বাতাসে
বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেতে থাকি তর্কে ও উল্লাসে।
সেই আমি মধ্যরাতে কবিতার খাতা খুলে
নির্জন নদীর ধরে একাকী পথিক
হাত দুটি যুক্তি-ছেঁড়া রূপের কাঙাল।
আমার কাঙালপনা দুর্লভ দু’একদিন
নীরাকেও করে তোলে
কিছু দয়াবতী
তীর্থের পুণ্যের মতো সামান্য লাবণ্য ছুঁয়ে দেয়
তীর্থের পূণ্যের মতো? তার চেয়ে কম কিংবা
বেশী নয়?
রত্ন-সিংহাসন আমি এ জন্মে দেখিনি একটাও
তবুও নারীর জন্য বৈদুর্যমণির সিংহাসন আমি
পেতে রাখি
যদি সে কখনো আসে, সেখানে সে বসবে না
জলে-ভেজা একটি পা
শুধু তুলে দেবে!
মিথ্যে নয়,
নীরা তুমি দেখো, সে রকমই সাজানো রয়েছে।।
নীরা তুমি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র
আমাকে দেবে না?
শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি
নদী-সহবাসে কাটে দিন
এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল
পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল
এই নদী তুমি!
বড় দেরি হয়ে গেল, আকাশে পোশাক হতে বেশি বাকি নেই
শতাব্দীর বাঁশবনে সাংঘাতিক ফুটেছে মুকুল
শোনোনি কি ঘোর দ্রিমি দ্রিমি?
জলের ভিতর থেকে সমুত্থিত জল কথা বলে
মরুভূমি মেরুভূমি পরস্পর ইশারায় ডাকে
শোনো, বুকের অলিন্দে গিয়ে শোনো
হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও।
কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা
চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে
কাছাকাছি আনো
নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো!
অপরাহ্নে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তোমার মুখের পাশে কাঁটা ঝোপ, একটু সরে এসো
এ-পাশে দেয়াল, এত মাকড়সার জাল!
অন্যদিকে নদী, নাকি ঈর্ষা?
আসলে ব্যস্ততাময় অপরাহ্নে ছায়া ফেলে যায়
বাল্যপ্রেম
মানুষের ভিড়ে কোনো মানুষ থাকে না
অসম্ভব নির্জনতা চৌরাস্তায় বিহ্বল কৈশোর
এলোমেলো পদক্ষেপ, এতদিন পরে তুমি এলে?
তোমার মুখের পাশে কাঁটা ঝোঁপ, একটু সরে এসো!
অন্তত একবার এ-জীবনে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুখের তৃতীয় সিঁড়ি ডানপাশে
তার ওপাশে মাধুর্যের ঘোরানো বারান্দা
স্পষ্ট দেখা যায়, এই তো কতটুকুই বা দূরত্ব
যাও, চলে যাও সোজা!
সামনের চাতালটি বড় মনোরম, যেন খুব চেনা
পিতৃপরিচয় নেই, তবু বংশ-মহিমায় গরীয়ান
একটা বাড় গাছ, অনেক পুরোনো
তার নিচে শৈশবের, যৌবনেরর মানত-পুতুল
এত ছায়াময় এই জায়গাটা, যেন ভুলে যাওয়া স্নেহ
ভুল নয়, ছায়া তো রয়েছে।
সদর দরজাটি একেবারে হাট করে রাখা
বড় বেশি খোলা যেন হিংসের মতন নগ্ন
কিংবা জঙ্গলের ফাঁসকল
আসলে তা নয়, পূর্বপুরুষের তহীর্ঘ পরিহাস
লেহার বলটুতে এত সুন্দর সাপানো এত দৃঢ়
আর বন্ধই হয় না!
ভিতরের তেজি আলো প্রথমে যে-সিঁড়িটা দেখায়
সেটা মিথ্যে নয়, দ্বিতীয়টি অন্য শরীকের
বাকি সব দিক, বলা-ই বাহুল্য, মেঘময়।
মনে করো, মল্লিক বাড়ির মতো মৃত কোনো পথিক স’াপত্য
ভাঙা শ্বেত পাথরেরা হাসে, কাঠের ভিতরে নড়ে ঘুণ
কত রক, পরিত্যক্ত দরদালান, চামচিকের থুতু
আর কিছু ছাতা-পড়া জলচৌকি, ঐখানে
লেগে আছে যৌনতার তাপ
ঐখানে লেগে আছে বড় চেনা নশ্বরতা।
তবু সবকিছু দূরে ছোঁয়া যায় না, এমন অসি’র মনোহরণ
মধ্যরাতে ডাকে, তোমাকে, তোমাকে!
দুপুরেও আসা যায়, যদি ভাঙে মোহ
অথবা ঘুমোয় ঈর্ষা পাগলের শুদ্ধতার মতো
তখন কী শান্ত, একা, হৃদয় উতলা
হে আতুর, হে দুঃখী, তুমি এক-ছুটে চলে যাও
ঐ মাধুর্যের বারান্দায়
আর কেউ না-দেখুক, অন্তত একবার এ জীবনে।।
অ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে
তবু ভালো, শোনার মতন কেউ নেই
সকলেই ঘোর অমাবস্যা দেখতে গিয়েছে সমুদ্রে
মনীশেরও পোশাকের মধ্যে আছে অতিশয় শশব্যন্ত অ-মনীশ
তার বন্ধু অ-সিদ্ধার্থ, অ-লাবণ্য এরাও গিয়েছে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে-
অ-ভালোবাসায় মগ্ন ওরা সব,
সকলেই এক হয়ে আছে
ও ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখে বাকিটুকু চুনকাম হয়
ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে সর্বস্ব নতুন
অ-ব্যবহৃত ক্রেন অ-মানুষ হয়ে উঁকি মারে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরন ভেঙে?-
মনীশ, মনীশ এসো, টেলিফোন, দূর থেকে কেউ…
অ-মনীশ ছুটে এলো,
কার জন্য? আমার নয়!
অ-লেখা চিঠিও ফিরে যায়, যে-রকম অ-দেখা স্বপ্নের বর্ণচ্ছট
ও আমার নয়, এই অ-সময় কেউ ডকবে না
বস’ত ঘুমই হয়নি কয়েক রাত, অতি দ্রুত চলছে মেরামত
কালই একটা কিছু হবে। সকালেই তৈরি থাকো,
তৈরি হও, কাল
আগামী কালের জন্য অপেক্ষায় আছে এই
জীবনের অ-বিপুল অ-পূর্ণতা
অ-মনীশ গেছে তার অ-বন্ধু ও অ-বান্ধবী
সকলের কাছে
কে যেন মনীশকে ডাকলো, মনীশের জাগরণ ভেঙে?
ও আমার নয় এই অ-সময়ে কেউ ডাকবে না।।
সহজ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেমন সহজ আমি ফোটালাম একলক্ষ ফুল
হঠাৎ দিলাম জ্বেলে কয়েকটা সুর্য চাঁদ তারা
আবার খেয়াল হলে এক ফুঁয়ে নেভালাম সেই জ্যোৎস্না
(মনে পড়ে কোন্ জ্যোৎস্না?) নেভালাম সেই রোদ (তাও মনে পড়ে?)
নিন্দুকে নানান কথা আমাকে দেখিয়ে বলবে, বিশ্বাস করো না।
হয়তো বলবে শিশু কংবা নির্বোধ অথবা
ম্যাজিকওয়ালা- ছেঁড়া তাঁবু ফাটা বজনা, নানান সেলাই
করা কালো কোর্তা গায়ে লোকটা কি মরণ খেলা
খেলাচ্ছে আহা রে ঐ মেয়েটার চোখে,
দর্শক ভুলছে না, হাসছে; আহা, শুধু অবঝ মেয়েটা
মায়ার ওষুখে ভুগছে; বিশ্বাস করো না।
দেখরে নিন্দুক দেখ, বামহাতে কনিষ্ঠ আঙউলে
ত্রিজগৎ ধরে আছি কেমন সহজে,
আমাকে অবাক চোখে দেখছে চেয়ে অন্ধকার, সমুদ্র, পাহাড়
শুধু কি তোরাই ভুললি বিস্ময়ের ভাষা!
আমার বাড়িতে আসবি, দেখবি সে কি আজব বাড়ি?
মাথার উপরে ছাদ-চেয়ে দেখ, চারদিকে, দেয়াল রাখিনি,
তোরাই দেয়াল ঘেরা, বুকে স্বপ্ন, শ্লেষ্মা নিয়ে চিরকাল থাকবি
সাবধানে আঙুলে বয়স গুণে-শখ করে সে দেয়ালে নানা ছবি এঁকে
আমার বাড়িতে দেখ অনুগত ভৃত্যের মতন
নানান জাতের হাওয়া ঘুরছে ফিরছে, ঝুল ঝাড়ছে ছাতের কার্নিসে।
নানান রঙের টান দিয়ে দেখছে, ব্যস্ত দিন রাত।
আমি বসে ছবি আঁকছি দেয়ালবিহীন ঘরে মেয়েটির চোখে
বাইরের ছবির চেয়ে চোখের মণিতে ছবি কেমন সহজ!
তোরাই নির্বোধ শিশু, ফিরে যা নিন্দুক-
আমাকে ম্যাজিকওয়ালা বললে তুমি বিশ্বাস করো না।।
বিবৃতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঊনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে উন্তিরিশে এসে
গর্ভবতী হলো, তার মোমের আলোর মতো দেহ
কাঁপালো প্রাণান্ত লজ্জা, বাতারে কুটিল সন্দেহ
সমস্ত শরীরে মিশে, বিন্দু বিন্দু রক্ত অবশেষে
যন্ত্রনার বন্যা এলো, অন্ধ হলো চক্ষু, দশ দিক,
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক।
দিবাসার্ধ পায়ে হেঁটে লিরি আমি জীবিকার দাসত্ব-ভিখারী
ক্লান্ত লাগে সারারাত, ক্লান্তি যেন অন্ধকার নারী।
একদা অসহ্য হলে বাহুর বন্ধনে পড়ে ধরা
যন্ত্রনায় জর্জরিতা দুঃখিনী সে আলোর স্বরূপে
মাংসের শরীর তার শুভক্ষণে সব ক্লান্তিহরা
মন্ডুকের মতো আমি মগ্ন হই সে কন্দর্প-কূপে।
তার সব ব্যর্থ হলো, দীর্ঘশ্বাসে ভরালো পৃথিবী
যদিও নিয়মনিষ্ঠা, স্বামী নামে স্বল্প চেনা লোকটির ছবি
শিয়রেতে ত্রুটিহীন, তবু তার দুই শঙ্খ স্তনে
পূজার বন্দনা বাজে আ-দিগন্ত রাত্রির নির্জনে।
সে তার শরীর থেকে ঝরিয়েছে কান্নার সাগর
আমার নির্মম হাতে সঁপেছে বুকের উপকূল,
তারপর শান্ত হলে সুখে-দুঃখে কামনার ঝড়
গর্ভের প্রাণের বৃন্তে ফুটে উঠলো সর্বনাশ-ফুল।
বাঁচাতে পারবে না তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বীরসিংহ শিশু
হবিষ্যান্নপুষ্ট দেহ ভবিষ্যের ভারে হলো মরণসম্ভবা
আফিম, ঘুমের দ্রব্য, বেছে নেবে আগুন, অথবা
দোষ নেই দায়ে পড়ে যদি-বা ভজনা করে যীশু।।
প্রার্থনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঋজু শাল অশ্বত্থের শিকড়ে শিকড়ে যত ক্ষুধা
সব তুমি সয়েছ, বসুধা।
স্তব্ধ নীল আকাশের দৃশ্য অন্তহীন পটভূমি
চক্ষুর সীমানা-প্রান্তে বেঁধে দিয়ে তুমি
এঁকে দিলে মাঠ বন বৃষ্টি-মগ্ন নদী-তার দুরাভাস তীর
আমাকে নিঃশেষে দিলে তোমার একান্ত মৃদু মাটির শরীর।
আমার জন্মের ভোর সূযর্য-শরে আহত মাটিতে
প্রত্যহকে ধরে থাকা অবাধ্য মুঠিতে।
নিবির ঘুমের মৌন জীবনের অস্পষ্ট আভাসে
নিস্পন্দ অন্ধকারে মিশে যায়,-বর্ণ ভেসে আসে,
লাগে স্পর্শ-উষ্ণ হাওয়া, দেখি চক্ষু ভ’রে
সূর্যমুখীর মতো মেলে আছো সেই এক অপরূপ ভোরে।
আমারও আকাঙক্ষা ছিল সূর্যের দোসর হবো তিমির শিকারে
সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে।
অথচ সময়াহত আপাত-বস’র দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত মনে
বর্তমান ভীত-চক্ষু মাটিতে ঢেকেছি সঙ্গোপনে।
দাঁড়াও ক্ষণিক তুমি স্তব্ধ করে কালচিহ্ন ভবিষ্যত অপার
হৃৎস্পন্দে দাও আলো-উৎসের ঝংকার।
নির্মম মুহূর্ত ছুঁয়ে বাঁচার বঞ্চনা স’য়ে স’য়ে
দুপুর – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য, দুপুরের অস্থির কুহক
অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু’চক্ষুর সীমা
পথ চলতে থম্কে গেলো অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক।
ভিজে চুল খুলেছে সে সুকুমার, উদাস আঙুলে
স্তনের বৃন্তের কাছে উদ্বেলিত গ্রীষ্মের বাতাস
কি যেন দেখলো মিলে এক সঙ্গে নিল দীর্ঘশ্বাস।
একজন যুবক শুধু দূর থেকে হেঁটে এসে ক্লান্ত রুক্ষ দেহে
সিগারেট ঠোঁটে চেপে শব্দ করে বারুদ পোড়ালো
সম্বল সামান্য মুদ্রা করতলে গুণে গুণে দেখলো সস্নেহে
এ মাসেই চাকবি হবে, হেসে উঠলো, চোখে পড়লো
অলিন্দের আলো।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, নির্লিপ্তের মতো চেয়ে বললো মনে মনে
কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শেষবার ফিরে দেখলো তাকে
রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে
এ যেন নদীর মতো, নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে।
এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার
রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।।
তুমি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভূরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করোছো অসীম।
বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনও ভাবি অপার্থিব কিনা।
সারাদিন পৃথিবীকে সূর্যের মতন
দুপুর-দগ্ধ পায়ে করি পরিক্রমা,
তারপর সায়াহ্নের মতো বিস্মরণ-
জীবনকে সি’র জানি তুমি দেবে ক্ষমা।
তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কার মুখর
তোমার সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখে জয়ের স্বাক্ষর।
যা কিছু বলেছি আমি মধুর অস্পূটে
অসি’র অবগাহনে তোমারি আলোকে
দিয়েছো উত্তর তার নব-পত্রপুটে
বুদ্ধের মূর্তির মতো শান্ত দুই চোখে।।
চতুরের ভূমিকা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কিছু উপমার ফুল নিতে হবে নিরুপমা দেবী
যদিও নামের মধ্যে বেখেছেন আসল উপমা
ক্ষণিক প্রশ্রয়-তুষ্টি চায় আজ সামান্য এ কবি,
রবীন্দ্রনাথেরও আপনি চপলতা করেছেন ক্ষমা।
যদিও প্রত্যহ আসে অগণিত সুঠাম যুবক
নানা উপহার আনে সময় সাগর থেকে তুলে
আমি তো আনি নি কিছু চম্পা কিংবা কুর্চি কুরুবক
সাজাতে চেয়েছি শুধু স্পর্শহীন উপমার ফুলে।
আকাশে অনেক সজ্জা, তবু স্থির আকাশের নীল
সামান্য এ সত্যটুকু, শোনাতে চেয়েছি আপনাকে
শব্দ আর অলঙ্কারে খুঁজে খুঁজে জীবনের মিল
দেখিছি সমস্ত সাধ অন্য এক বুকে সুপ্ত থাকে।
আশা করি এতক্ষণে এঁকেছি আমার পটভূমি।
যদি অনুমতি হয় আজ থেকে শুরু হোক, তুমি।।
আরও পড়ুন: