আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা | বাংলা রচনা

আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা একটি নমুনা তৈরি করবো আজ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিষয়টি নিয়ে আপনাকে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য রচনা লিখতে হয়। আবার অনেক সময় বক্তৃতা দেবার প্রয়োজন হয়। রচনাটি আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়লে পরীক্ষার জন্য রচনা বা বক্তৃতা দেয়া সহজ হয়ে যাবে। আমাদের লিখিত নমুনা থেকে ধারণা নিন, এরপর নিজের মতো লিখুন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা | বাংলা রচনা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা | বাংলা রচনা

 

ভূমিকা :

‘আজকের মেয়ে আগামী দিনের নারী’-এ প্রতিপাদ্য নিয়ে ৮ মার্চ বাংলাদেশসহ বিশ্বের সর্বত্র পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। উন্নততর কার্য পরিবেশ ও বেতনভাতা আদায়ের দাবিতে প্রায় দেড়শ’ বছর আগের ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের যেসব নারী শ্রমিক জীবন উৎসর্গ করেছিল তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যেই বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি উদযাপিত হয়। এ দিবসে প্রতিবছর নারীসমাজের সংগ্রামী ইতিহাসের কথা যেমন স্মরণ করা হয় তেমনি, দেশে দেশে নারীসমাজের অবস্থারও মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস :

নারী মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাস অতি প্রাচীন। নারীদের এক দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসেবে এসেছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ সংগ্রামের সূত্রপাত হয় ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। আজ থেকে ১৪৪ বছর পূর্বে ১৮৫৭ সালের এদিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে সেলাই কারখানার মুক্তিকামী নারী শ্রমিকরা অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্প মজুরি ও অধিক শ্রমের বিরুদ্ধে এবং বারো ঘণ্টার কর্মদিবস পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন নেমেছিল।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

সুই নারী শ্রমিকরা মজুরি পেত পুরুষের তুলনায় অনেক কম। তারা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে আন্দোলনরত নারী শ্রমিকদের ওপর চালানো হয় পুলিশি নির্যাতন, মিছিলে চালানো হয় নির্বিচারে গুলি, গ্রেপ্তার করা হয় বহু নারী শ্রমিককে । গুলিতে বহু নারী শ্রমিক প্রাণ হারায় । কিন্তু এ নির্যাতন ও হত্যা তাদের অবদমিতকরতে পারেনি। তারা গুপ্ত তৎপরতার ভেতর দিয়ে তিন বছরের মাথায় ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ গড়ে তোলে নিজস্ব ইউনিয়ন।

এ ইউনিয়নে একত্রিত হয়ে তারা তাদের আন্দোলনে ব্যাপকতা সৃষ্টি করে। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ তাদের সাথে যোগ দেয় পোশাক ও বস্ত্র কারখানার নারী শ্রমিকরা। এর দু বছর পর ১৯১০ সালের ৮ মার্চ কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে বিশ্বনারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেই থেকে সারা বিশ্বে দিবসটি নারীর অধিকার আদায়ের দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব নারীর সাম্প্রতিক চিত্র :

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি হলেও বিশ্বে নারীদের অবস্থার ক্ষেত্রে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ কথা সত্য যে, বিশ্বের বহুদেশে নারীরা সমাজের সম্মুখ সারিতে এগিয়ে এসেছেন, বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বহু সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। তারপরও একথা বলা যায়, বিশ্বের বহুদেশেই তাদের অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হতে এখনো অনেক বাকি। এখনো তারা হচ্ছেন বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। উন্নত, অনুন্নত সবদেশেই বিপুলসংখ্যক নারী বাস করছেন দারিদ্রসীমার নিচে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ইতালি প্রভৃতি উন্নত দেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী বাস করেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। ঐ তথ্যে আরো জানা যায়, বিশ্বে অশিক্ষিত নারী-পুরুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই হচ্ছে নারী। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজনের মধ্যে কমপক্ষে একজন নারী প্রহার, বলপূর্বক যৌন সংসর্গ বা অন্য কোনোভাবে পীড়নের শিকার হচ্ছেন, যার বেশির ভাগই ঘটছে তার স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনো পুরুষ সদস্য বা ঘনিষ্ঠ জনের দ্বারা। প্রতিবছর সারা বিশ্বে পাঁচ থেকে পনের বছর বয়সী বিশ লাখ মেয়েকে জোর করে পতিতাবৃত্তিতে নামানো হচ্ছে ।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের মোট কাজের ৫৪ শতাংশ করে মেয়েরা। অথচ তাদের কাজের তিন-চতুর্থাংশের কোনো পারিশ্রমিক তারা পায় না। আর উন্নত বিশ্বের ৫১ শতাংশ কাজ করে মেয়েরা। আফ্রিকাতে ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্য মেয়েরা ফলায় এবং মোট কৃষি কর্মীর ৬০ শতাংশ মহিলা। ১৯৯৬ সালের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে ঋণ দিয়েছে, তারা ৫ থেকে ৭ শতাংশ মাত্র মেয়েদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গৃহবধূ যদি ঘরের কাজকর্মের জন্য বাৎসরিক মূল্য চায়, তবে সে ১৪ হাজার ৫০০ ডলার বেতন দাবি করতে পারে।

জি-৮ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩০-৪০ শতাংশই করে থাকে গৃহবধূরা। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এবং মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে নারী এবং তার মোট শ্রম ঘণ্টার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মে নিয়োজিত থাকে। অথচ মোট মজুরির এক-দশমাংশ মাত্র তাদের ভাগ্যে জোটে এবং মোট সম্পত্তির কথা ধরলে মাত্র ১০০ ভাগে ১ ভাগ তারা পেয়ে থাকে। নারী উন্নয়নের দিক থেকে আলোচনা করলে দেখা যায় ‘পৃথিবীর অসম নাগরিকদের মধ্যে সর্বাধিক অসম হচ্ছে নারী।’

বিশ্বব্যাপী নারীর মর্যাদা, অধিকার আর ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও নারী আজ অবধি অবহেলিত। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট মতে, বিশ্বব্যাপী মাত্র তিন শতাংশ উচ্চপদের নির্বাহী আসনে নারী সমাসীন। বিশ্বের আটটি মাত্র দেশে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান রয়েছে। আর আইন প্রণেতা বা সংসদ সদস্য আছে ১৪%-এর কম। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বে রয়েছে মাত্র ১%। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, বিশ্বের মহিলা কর্মজীবীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও তাদের উচ্চপদে পৌঁছার বিষয়টি এখনো প্রায় অসম্ভব ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

বাংলাদেশে নারীর বর্তমান অবস্থান :

মানবজাতির অর্ধেক অংশ হয়েও নারীরা আজ বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশাসনের জালে আবদ্ধ নারীসমাজ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান সর্বোপরি সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি নানারকম সুযোগ-সুবিধা থেকে নারীরা বঞ্চিত, যদিও নারীরা কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। জীবিকার প্রয়োজনে ও আর্থ-সামাজিক কারণে নারীরা বিপুল সংখ্যায় বাইরের কর্মক্ষেত্রে অংশ নিচ্ছে।

নারীর সমঅধিকার ও নারীমুক্তির কথা জোরগলায় বলা হচ্ছে কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত অবগতি হয়নি। এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী। গৃহ পরিচারিকার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের খবরও পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই আসছে। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীসমাজের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি সেক্টর গার্মেন্টস শিল্পে কাজ  করছে অগণিত নারী শ্রমিক। পরীক্ষার মেধা তালিকায় চোখ বুলালেও দেখা যায় মেয়েদেরই প্রাধান্য। তারপরও সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না।

চলার প্রতিটি পদক্ষেপেই নারী অসাম্যের মুখোমুখি হয়। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের অসম অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষা রাষ্ট্রের আয়নায় এখনো নারীর অমর্যাদার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরে। অথচ, গত তিন দশকে বিশ্বের নানা দেশে নারী এগিয়ে গেছে অনেক দূর। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার নারীসমাজে প্রচুর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সেসব দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নারীরা যথেষ্ট মর্যাদা পাচ্ছে । অবশ্য তা সমানাধিকারের মর্যাদা নয় ।

অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নারী :

অর্থনীতিতে নারীর অবদান কোনো অংশেই খাটো করে দেখার নয়। অথচ গার্হস্থ্য জীবনের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ বলে এর কোনো স্বীকৃতিই নেই। সারা বিশ্বের পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামীণ নারীদের যে অবদান তার কোনো মূল্যায়নই হয় না। অন্ধকার গৃহকোণ থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখে নারীর এসব মজুরিবিহীন কাজকর্ম। রাজনীতির কথা যদি ধরি, রাজনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোয় নারীসমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র  প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারীরা রাজনীতিকে কল্যাণমুখী ও গতিশীল করতে সক্ষম।

নারী উন্নয়ন কেন প্রয়োজন :

নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি নারী-পুরুষ সবার অর্থাৎ সমগ্র সমাজের। এর সাথে মানবজাতির কল্যাণের প্রশ্ন জড়িত। নারীর মর্যাদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায় একটি দেশ কতখানি উন্নত বা সভ্য। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেয়ার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক, যথাযথ মর্যাদা। মনে রাখতে হবে বিশ্বের মেধা, দক্ষতা, প্রতিভার অর্ধেক ভাঙার সঞ্চিত রয়েছে নারীর কাছে। এ অব্যবহৃত বা স্বল্প ব্যবহৃত মানবসম্পদের সদ্ব্যবহার পুরো মানবজাতির স্বার্থেই জরুরি।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস | আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার :

নারীর অধিকার ও মর্যাদার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করে দেয়ার জন্য প্রতিবছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। একজন শিক্ষিত মাতাই গড়ে তুলতে পারে একটি শিক্ষিত শিশু। শিক্ষিত শিশুই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষিত এ শিশুই আগামী দিনে জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই উন্নত দেশ ও জাতি গঠনের পূর্বশর্ত শিক্ষিত শিশু গড়ার কারিগর শিক্ষিত মাতা গড়ে তোলা। আর সে পূর্বশর্ত পালনের লক্ষ্যই শুধু সরকারি পদক্ষেপ আর মহিলা সংগঠনগুলোর ওপর দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। বরং সমাজের সকলের যে দায়িত্ব রয়েছে তা সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। আর এর ওপর নির্ভর করছে একটি সুস্থ-শিক্ষিত-স্বাবলম্বী উন্নত দেশ ও জনগোষ্ঠী। এটাই হোক বিশ্ব নারী দিবসের অঙ্গীকার ।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment